**উত্তর কলম্বিয়ার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: খরা ও বন্যার সঙ্গে সংগ্রাম**
কলম্বিয়ার উত্তরাঞ্চলে, বিশেষ করে ভেনেজুয়েলা থেকে আসা আদিবাসী ওয়ায়ু সম্প্রদায়ের মানুষজন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। তীব্র খরা এবং আকস্মিক বন্যায় তাদের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ঘরবাড়ি হারিয়ে তারা উদ্বাস্তু জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন এবং খাবার পানির অভাবে তাদের জীবন আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি, ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে তাদের তৈরি করা অস্থায়ী ঘরগুলি পানিতে তলিয়ে গেছে। খবর প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)।
ওয়ায়ু হলো কলম্বিয়ার বৃহত্তম আদিবাসী গোষ্ঠী। তাদের ঐতিহ্যবাহী ভূমি কলম্বিয়া এবং ভেনেজুয়েলার মাঝে বিস্তৃত। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট এই সংকট তাদের জীবনযাত্রাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন যে, বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খরা এবং অতিবৃষ্টির মতো চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলো আরও বাড়বে। এর ফলে শুধু ঘরবাড়ির ক্ষতিই হচ্ছে না, বরং খাবার পানির উৎসও শুকিয়ে যাচ্ছে, যা তাদের জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য। অনেক ওয়ায়ু পরিবার জীবন বাঁচাতে ইতিমধ্যেই শহরগুলোতে পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়েছে, যার ফলে শহরের বস্তিগুলোতে জনসংখ্যার চাপ আরও বেড়েছে।
রিওআচা শহরের উপকণ্ঠে বসবাসকারী ৪৭ বছর বয়সী নেলি মেঙ্গুয়াল জানান, কয়েক মাস আগে বন্যা তার বাড়ির চাল উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল, ফলে হাঁটু পর্যন্ত জল জমে গিয়েছিল। তিনি জানান, “আমাদের সামান্য যা কিছু ছিল, সবই হারিয়ে গেছে।” নেলি এখন ময়লার ব্যবসা করে কোনোমতে সংসার চালান।
ওয়ায়ু সম্প্রদায়ের আরেক সদস্য, ইনগ্রিড গঞ্জালেজ, যিনি ছয় বছর ধরে রিওআচার কাছে বসবাস করছেন, বলেছেন যে তাদের ঐতিহ্যবাহী বাড়িগুলো, যা কাঠ এবং কাদা দিয়ে তৈরি, বর্ষাকালে সহজে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। “বৃষ্টিতে অনেক ঘর পানিতে ভরে যায়,” তিনি বলেন। “এখানে পানির প্রবল স্রোত বয়ে যায় এবং মাটির ঘরগুলো ভেঙে যায়।”
লা গুয়াজিরার পরিবেশ কর্তৃপক্ষ কর্পোগুয়াইরার প্রধান স্যামুয়েল লানো জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের শীতকালীন বন্যায় আদিবাসী সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি, ফসল এবং গবাদি পশুর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, বিশেষ করে যারা প্রতিবেশী ভেনেজুয়েলা থেকে এসেছেন। “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ডেঙ্গু এবং জিকার মতো রোগ বেড়েছে। ডেঙ্গু আদিবাসী সম্প্রদায়ের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে,” তিনি যোগ করেন।
ড্যানিশ রিফিউজি কাউন্সিলের লা গুয়াজিরা অঞ্চলের ব্যবস্থাপক ক্যামিলো মার্টিনেজ ১৪ বছর ধরে এই অঞ্চলে কাজ করছেন। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তিনি জানান, “আগে এখানে ঘন কুয়াশা থাকত এবং সকালের দিকে ঠান্ডা অনুভব হতো। এখন আর তেমনটা দেখা যায় না।”
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রমাণস্বরূপ, কলম্বিয়ার জলবিজ্ঞান, আবহাওয়া ও পরিবেশ গবেষণা ইনস্টিটিউট (IDEAM) এর তথ্য এবং বিভিন্ন গবেষণায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি, দীর্ঘস্থায়ী খরা এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের বিষয়টি উঠে এসেছে।
আদিবাসী ওয়ায়ু সম্প্রদায়ের অনেকেই ঐতিহ্যবাহী জীবনযাপন করেন, যেখানে তারা মাটির ঘর তৈরি করে বসবাস করেন এবং গবাদি পশু পালন করেন। অনেক বস্তিতে বাসিন্দাদের খাবার পানি ও স্যানিটেশন সুবিধার অভাব রয়েছে। পানির ব্যবসায়ীরা পশুদের পিঠে করে অপরিষ্কার পানি সরবরাহ করে, যা তাদের জীবনকে আরও কঠিন করে তোলে।
ওয়ায়ু নেতা আনিবাল মার্কাডো এপিকে বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অভিবাসী ওয়ায়ু জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। “তাদের পুনর্বাসন এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের উদাসীনতা দেখা যায়। সরকার ঐতিহ্যগত অধিকারের বিরুদ্ধে এমন নীতি গ্রহণ করছে যা তাদের জীবন ধারণের জন্য সহায়ক ছিল না,” তিনি বলেন।
এই পরিস্থিতিতে অনেক আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা লা গুয়াজিরা অঞ্চলে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে, যেখানে সরকারি সাহায্য খুবই কম।
যেমন বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষজন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উদ্বাস্তু হয়, তেমনি কলম্বিয়ার ওয়ায়ু সম্প্রদায়ের মানুষজনও জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে উদ্বাস্তু হচ্ছেন। উন্নত দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট এই সংকট মোকাবিলায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পাশে দাঁড়ানো উচিত।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস