রক্তের অভাব মেটাতে কৃত্রিম রক্তের গবেষণা: বাংলাদেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
বাংলাদেশে রক্তের সংকট একটি পরিচিত সমস্যা। অনেক সময় জরুরি পরিস্থিতিতে রক্তের অভাবে রোগীদের জীবন সংকটে পরে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বে রক্তের অভাবে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। উন্নত দেশগুলোতেও এই সমস্যা বিদ্যমান, তবে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। এই প্রেক্ষাপটে, বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম রক্ত তৈরির চেষ্টা করছেন, যা হয়তো ভবিষ্যতে এই সংকট সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
কৃত্রিম রক্ত আসলে কি? এটি প্রধানত দুই ধরনের: পরীক্ষাগারে তৈরি করা রক্ত (Lab-grown blood) এবং সিনথেটিক বা কৃত্রিম রক্ত (Synthetic blood)। পরীক্ষাগারে তৈরি রক্ত মানুষের শরীরের বাইরে বিশেষ পরিবেশে স্টেম সেল থেকে তৈরি করা হয়। অন্যদিকে, সিনথেটিক রক্ত তৈরি করা হয় রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করে এবং এতে কোনো কোষ থাকে না। সিনথেটিক রক্তের মূল উদ্দেশ্য হলো জরুরি পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক অক্সিজেন সরবরাহ করা, যেখানে রক্তের গ্রুপ মেলানোর সুযোগ থাকে না।
বর্তমানে কৃত্রিম রক্ত তৈরির গবেষণা কোন পর্যায়ে আছে?
২০২২ সালে, যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীরা পরীক্ষাগারে তৈরি করা লোহিত রক্তকণিকা (red blood cells) মানুষের শরীরে প্রবেশ করিয়ে এর নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা পরীক্ষা করেছেন। এছাড়া, জাপানে হিমোগ্লোবিন ভেসিকল (hemoglobin vesicles) নিয়ে একটি ছোট গবেষণা হয়েছে, যেখানে দেখা হয়েছে এগুলো সাধারণ রক্ত সঞ্চালনের বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে কিনা। তবে, এখনো পর্যন্ত কৃত্রিম রক্ত বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন পাওয়া যায়নি।
এই প্রযুক্তি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও এর সম্ভাবনা অনেক। বিশেষ করে, রক্তের বিরল গ্রুপ (rare blood group) রয়েছে এমন রোগীদের জন্য এটি জীবনদায়ী হতে পারে। কারণ, কৃত্রিম রক্ত সব ধরনের মানুষের শরীরে ব্যবহার করা সম্ভব হতে পারে। এছাড়া, যুদ্ধ, মহামারী বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো জরুরি পরিস্থিতিতে যখন রক্তের চাহিদা বেড়ে যায়, তখন কৃত্রিম রক্ত সরবরাহ করা সহজ হবে।
কৃত্রিম রক্ত তৈরির পথে কি কি চ্যালেঞ্জ রয়েছে?
কৃত্রিম রক্ত তৈরি করা সহজ নয়। এর উৎপাদন খরচ এখনো অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৩ সালে এক ইউনিট কৃত্রিম রক্ত তৈরি করতে প্রায় ৯০,০০০ ডলার খরচ হতো, যা বর্তমানে ৫০০০ ডলারে নেমে এসেছে। যদিও এই খরচ কমেছে, তবুও এটি সাধারণ রক্তের চেয়ে অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে এক ইউনিট সাধারণ রক্তের গড় দাম প্রায় ২$১৫ ডলার। এছাড়া, এই প্রযুক্তি এখনো নিয়ন্ত্রক সংস্থার (regulatory bodies) অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (FDA) এবং ইউরোপীয়ান মেডিসিন্স এজেন্সি (European Medicines Agency) এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি যে কৃত্রিম রক্তকে সেল থেরাপি (cell therapy) হিসেবে বিবেচনা করা হবে নাকি ঔষধ হিসেবে, যা এর নিয়ন্ত্রন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করবে।
বাংলাদেশের জন্য এর গুরুত্ব
বাংলাদেশে রক্তের চাহিদা ও সরবরাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাসপাতালগুলোতে রক্তের সংকট প্রায়ই দেখা যায়। কৃত্রিম রক্ত তৈরি হলে এই সংকট অনেকাংশে কমানো সম্ভব হবে। এছাড়াও, বিভিন্ন দুর্ঘটনায় আহত রোগীদের জন্য এটি জীবন রক্ষাকারী হিসেবে কাজ করতে পারে।
তবে, কৃত্রিম রক্ত এখনো বেশ ব্যয়বহুল। তাই, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এটি সহজলভ্য করতে হলে উৎপাদন খরচ কমানো এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। ভবিষ্যতে, যদি কৃত্রিম রক্ত সহজলভ্য হয়, তবে তা বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনবে, যা রোগীদের জীবন বাঁচাতে সহায়ক হবে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা