অস্কার জয়: অ্যানিমেশন জগতে নতুন দিগন্ত, হলিউডের বাইরেও সাফল্যের গল্প
অ্যানিমেশন ফিল্মের জগতে এক নতুন পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। বড় স্টুডিওর জাঁকজমকপূর্ণ নির্মাণ শৈলীকে পাশ কাটিয়ে, স্বল্প বাজেটের স্বাধীন ধারার ছবিগুলো এখন বিশ্বজুড়ে দর্শক ও সমালোচকদের মন জয় করছে। সম্প্রতি, এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে গিন্টস জিলবালোদিসের (Gints Zilbalodis) ‘ফ্লো’ (Flow) নামের একটি ছবি। এই ছবিটি সেরা অ্যানিমেটেড ফিচার ফিল্ম বিভাগে অস্কার জয় করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।
‘ফ্লো’ ছবিতে কোনো সংলাপ নেই, মানুষও নেই। একটি বিড়াল, একটি ক্যাপিবারা (এক প্রকার ইঁদুর জাতীয় প্রাণী) এবং একটি লেমুর (বাদরের মতো দেখতে) – এই তিন প্রাণীর জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে ছবিটির গল্প। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাদের টিকে থাকার সংগ্রাম, একে অপরের প্রতি নির্ভরশীলতা – এইসব বিষয়গুলো অত্যন্ত মানবিক ও আকর্ষণীয়ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। লাটভিয়ার (Latvia) তরুণ নির্মাতা জিলবালোদিস-এর এই সৃষ্টি দর্শকদের মন জয় করেছে।
শুধু ‘ফ্লো’ নয়, এই বছর আরও কয়েকটি স্বাধীন অ্যানিমেশন ছবি পুরস্কারের জন্য আলোচনায় এসেছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – অ্যাডাম এলিয়টের (Adam Elliot) ‘মেমোর অফ আ স্নেইল’ (Memoir of a Snail) এবং নিনা গান্টজের (Nina Gantz) ‘ওয়ান্ডার টু ওয়ান্ডার’ (Wander to Wonder)। এই ছবিগুলো তাদের গল্প বলার নিজস্বতা এবং নির্মাণ শৈলীর কারণে আলাদা পরিচিতি লাভ করেছে। স্বল্প বাজেট, হাতে আঁকা চরিত্র, স্টপ-মোশন-এর মতো কৌশল ব্যবহার করে তারা অ্যানিমেশনকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে।
স্বাধীন ধারার অ্যানিমেশন নির্মাতারা সাধারণত সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে কাজ করেন। জিলবালোদিস-এর ‘ফ্লো’-এর বাজেট ছিল প্রায় ৩ কোটি টাকা (বাংলাদেশি মুদ্রায়)। অন্যদিকে, বড় স্টুডিওর ছবি, যেমন ‘ইনসাইড আউট ২’ (Inside Out 2)-এর বাজেট প্রায় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি! এই বিশাল পার্থক্যের পরও, স্বাধীন নির্মাতারা তাদের কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন, ভালো গল্প বলার জন্য বিপুল অর্থ বা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সবসময় প্রয়োজন হয় না।
অ্যাডাম এলিয়ট মনে করেন, অ্যানিমেশন একটি মাধ্যম, কোনো নির্দিষ্ট ধারা নয়। তার মতে, কম্পিউটার অ্যানিমেশন-এর যুগেও হাতে গড়া শিল্পকর্মের কদর বাড়ছে। তিনি বলেন, “যখন আমি কাজ শুরু করি, তখন আমাকে বলা হতো, আমি একটি মৃতপ্রায় শিল্পকলার চর্চা করছি। কিন্তু এখন, হাতে তৈরি শিল্পের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে, যা খুবই ইতিবাচক।”
স্বাধীন অ্যানিমেশন নির্মাতাদের এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে তাদের কাজের স্বাধীনতা। তারা প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে নিজেদের মতো করে গল্প বলতে পারেন। তাদের ছবিতে থাকে গভীরতা, যা দর্শকদের নতুন কিছু দেয়। তবে, এই পথে চলতে গেলে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। অর্থ সংকট, সীমিত জনবল – এইসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে হয় তাদের।
তবে, নির্মাতারা মনে করেন, এই চ্যালেঞ্জগুলো তাদের কাজকে আরও মূল্যবান করে তোলে। নিনা গান্টজ বলেন, “কাজের প্রতি ভালোবাসা এবং ছবির প্রতি আবেগই আমাকে টিকিয়ে রেখেছে।”
হলিউডের বড় স্টুডিওগুলোও এখন স্বাধীন ধারার অ্যানিমেশন নির্মাতাদের প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। তারা মনে করছে, নতুনত্বের জন্য এই ধরনের নির্মাতাদের সহযোগিতা প্রয়োজন। কারণ, অ্যানিমেশন ছবি তৈরির পুরনো ধারা এখন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।
অ্যানিমেশন জগতে এই পরিবর্তন শুধু একটি সিনেমার জয় নয়, বরং এটি একটি নতুন দিগন্তের সূচনা। এটি প্রমাণ করে, ভালো গল্প বলার ক্ষমতা থাকলে, সীমিত সম্পদ নিয়েও বিশ্ব জয় করা সম্ভব।
তথ্য সূত্র: The Guardian