সেন্ট প্যাট্রিক’স ডে: আয়ারল্যান্ডের এই উৎসবের আসল গল্প।
প্রতি বছর ১৭ই মার্চ তারিখে সারা বিশ্বে পালিত হয় সেন্ট প্যাট্রিক’স ডে। আয়ারল্যান্ডের এই ঐতিহ্যপূর্ণ উৎসব এখন বিশ্বজুড়ে এক আনন্দময় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে, কে ছিলেন সেন্ট প্যাট্রিক এবং কেনই বা এই দিনটি এত গুরুত্বের সাথে উদযাপন করা হয়? আসুন, এই উৎসবের পেছনের গল্পটি জেনে নেওয়া যাক।
সেন্ট প্যাট্রিক ছিলেন আয়ারল্যান্ডের ধর্মীয় সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তিত্ব। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, প্রায় ১৬০০ বছর আগে তিনি জীবন যাপন করতেন।
আয়ারল্যান্ডের ইতিহাসে তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি শুধু একজন ধর্মপ্রচারকই ছিলেন না, বরং আয়ারল্যান্ডের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গেও তার নাম জড়িয়ে আছে।
কথিত আছে, তিনি প্রায় ১ লক্ষ ৩৫ হাজার মানুষকে খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন, ৩০০টি গির্জা স্থাপন করেন এবং আরও প্রায় ৩৫০ জন বিশপকে পবিত্র করেন।
সেন্ট প্যাট্রিক’স ডে-র উদযাপন মূলত সেন্ট প্যাট্রিকের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে করা হয়। যদিও আয়ারল্যান্ডে এই উৎসবের প্রচলন ছিল অনেক আগে থেকেই, তবে সপ্তদশ শতকের শুরুতে এটি সরকারিভাবে স্বীকৃতি লাভ করে।
শুরুতে এটি ছিল একটি ধর্মীয় উৎসব, যেখানে সকলে সকালে গির্জায় যেতেন এবং সন্ধ্যায় ভোজের আয়োজন করতেন। সময়ের সাথে সাথে, আয়ারল্যান্ডের বাইরে এই উৎসব ছড়িয়ে পরে এবং এটি আরও বেশি আনন্দ-উৎসবের রূপ নেয়।
বর্তমানে, সারা বিশ্বে এই দিনে আয়ারল্যান্ডের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরা হয় নানান বর্ণিল আয়োজনের মধ্যে দিয়ে।
কিন্তু সেন্ট প্যাট্রিক আসলে কে ছিলেন? আশ্চর্যের বিষয় হল, সেন্ট প্যাট্রিক আয়ারল্যান্ডের মানুষ ছিলেন না। ঐতিহাসিকদের মতে, তিনি ৩য় শতকের শেষের দিকে ব্রিটেনে এক ধনী রোমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
তার বাবার পেশা ছিল ডিকন এবং দাদার পেশা ছিল পুরোহিত। যদিও তার পরিবার খ্রিস্টান ছিল, সেন্ট প্যাট্রিকের জীবনের প্রথম দিকে ধর্মীয় প্রভাব তেমন একটা ছিল না।
একসময় আইরিশ জলদস্যুরা তাকে ধরে নিয়ে যায় এবং ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে। এরপর তিনি প্রায় ছয় বছর আয়ারল্যান্ডে একজন মেষপালক হিসেবে জীবন কাটান।
এই সময়টাতে তিনি ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। এক রাতে তিনি স্বপ্নে ঈশ্বরের কাছ থেকে আয়ারল্যান্ড থেকে পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ পান এবং এক জাহাজে করে ব্রিটেনে ফিরে আসেন।
ব্রিটেনে আসার পরেই তিনি আবার এক দৈববাণী শোনেন, যেখানে তাকে আয়ারল্যান্ডে ফিরে যেতে বলা হয়। এরপর তিনি যাজক হওয়ার প্রশিক্ষণ নেন এবং প্যাট্রিক নাম ধারণ করে আয়ারল্যান্ডে ফিরে আসেন।
অনেকে মনে করেন সেন্ট প্যাট্রিকই প্রথম আয়ারল্যান্ডে খ্রিস্ট ধর্ম নিয়ে এসেছিলেন, তবে এটি সঠিক নয়। কারণ, তার আগেই সেখানে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল।
তিনি বরং খ্রিস্ট ধর্মকে জনপ্রিয় করে তোলেন। তিনি আইরিশ রীতিনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মকে মিশিয়ে দেন, যা মানুষের কাছে এটিকে আরও সহজ করে তোলে।
উদাহরণস্বরূপ, তিনি পবিত্র আত্মার প্রতীক হিসেবে শামুকের পাতা ব্যবহার করতেন এবং ইস্টার উৎসবের সূচনা করেন।
সেন্ট প্যাট্রিক’স ডে-তে সবুজ রং ব্যবহারের কারণ কি?
সেন্ট প্যাট্রিক’স ডে-তে সবুজ পোশাক পরার একটি বিশেষ কারণ রয়েছে। একসময় এই দিনের মূল রং ছিল নীল।
তবে আইরিশরা যখন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, তখন তারা তাদের প্রতীক হিসেবে সবুজ রং বেছে নেয়, যা শেমরকের(এক ধরনের ক্লোভার পাতা) রঙের সাথে মিলে যায়।
এরপর থেকেই সবুজ রং আইরিশ ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। এই কারণে, যারা আয়ারল্যান্ড থেকে অন্য দেশে গিয়েছেন, তারাও তাদের সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে সবুজ রং ব্যবহার করতে শুরু করেন।
এছাড়াও, লোককথায় শোনা যায় যে, সবুজ রং পরলে নাকি “লেপ্রিকন” নামক এক ধরনের পরীর উৎপাত থেকে বাঁচা যায়। লেপ্রিকনরা হলো আইরিশ লোককথার এক ধরনের দুষ্টু প্রাণী।
তাদের হাত থেকে বাঁচতে সবুজ পোশাকের জুড়ি নেই!
সেন্ট প্যাট্রিক’স ডে-র উদযাপন শুধু আয়ারল্যান্ডেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বিশ্বজুড়ে এই উৎসবের জনপ্রিয়তা রয়েছে।
এই দিনে বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোকেও সবুজ আলোয় সজ্জিত করা হয়।
সেন্ট প্যাট্রিকের গল্প পরিবর্তনের গল্প। জীবনের কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে তিনি যে পরিবর্তন এনেছিলেন, তা আজও মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।
তাই, আয়ারল্যান্ডের এই মহান ব্যক্তিত্বকে সম্মান জানাতে সেন্ট প্যাট্রিক’স ডে-র উদযাপন আজও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
তথ্যসূত্র: ট্রাভেল এন্ড লেজার।