বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ঢেউয়ে যিনি সার্ফ করেন, সেই মায়া গাবেইরার সমুদ্র বাঁচানোর লড়াই।
পর্তুগালের উপকূলের একটি শান্ত শহর নাজার। বছরের বেশিরভাগ সময় এখানে সমুদ্র থাকে শান্ত। কিন্তু শীতকালে এখানকার সমুদ্রের নিচে থাকা গিরিখাত দিয়ে যখন বিশাল ঢেউগুলো বয়ে যায়, তখন তা এক অন্যরকম রূপ নেয়।
এই ঢেউগুলোকে তুলনা করা হয় যেন সমুদ্রের বুকে জেগে ওঠা এক একটি পাহাড়ের সঙ্গে। ২০১৪ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সার্ফাররা এখানে আসেন, যাদের প্রধান আকর্ষণ থাকে এই দৈত্যাকার ঢেউগুলো।
এই নাজারে আসা কয়েকজন সাহসী নারীর মধ্যে অন্যতম হলেন মায়া গাবেইরা। ব্রাজিলের এই নারীর সার্ফিংয়ের প্রতি ভালোবাসা ছিল চোখে পড়ার মতো। তিনি সবসময় বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঢেউগুলোতে সার্ফিং করতে চাইতেন।
অনেকে হয়তো তার এই স্বপ্নকে অসম্ভব বলতেন, কিন্তু মায়া ছিলেন অদম্য।
ছোটবেলায় মায়া বেড়ে উঠেছেন রিও ডি জেনেইরোর সমুদ্রের কাছাকাছি। তার শরীরে ছিল অ্যাজমার মতো রোগ, সেই সঙ্গে ছিল শ্বাসকষ্টের চরম ভয়।
অনেকেই হয়তো সমুদ্র থেকে দূরে থাকতে চাইতেন, কিন্তু মায়া ছিলেন ভিন্ন প্রকৃতির। তিনি যেন সমুদ্রকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন। ২০১৬ সালের একটি তথ্যচিত্রে মায়ার জীবনের এই দিকটি তুলে ধরা হয়েছে।
কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তার।
শুরুতে নাজারের বিশাল ঢেউগুলোতে সার্ফিং করা মায়ার জন্য সহজ ছিল না। ২০১৩ সালে একবার বিশাল এক ঢেউয়ের ওপর সার্ফিং করার সময় তিনি গুরুতর আহত হন।
ঢেউয়ের ধাক্কায় তিনি জলের নিচে তলিয়ে যান, পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিতে হয়। এই ঘটনা তার জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
এরপর বেশ কয়েকবার অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে তাকে। শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি মানসিক দিক থেকেও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি।
কিন্তু মায়া হাল ছাড়েননি। অস্ত্রোপচারের পর দীর্ঘ চার বছর ধরে সেরে ওঠার পর তিনি আবার ফিরে আসেন। ২০১৮ সালে তিনি ৬৮ ফুটের একটি বিশাল ঢেউয়ে সার্ফিং করেন, যা ছিল একজন নারীর সার্ফিং করা সবচেয়ে বড় ঢেউ।
এরপর ২০২০ সালে তিনি নিজের রেকর্ড ভেঙে ৭৩.৫ ফুটের একটি ঢেউয়ে সার্ফিং করেন। সে বছর পুরুষ এবং নারী উভয়ের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে সফল সার্ফার।
সমুদ্রে কাটানো এতগুলো বছর মায়াকে সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রের সমস্যাগুলো সম্পর্কে সচেতন করেছে। বিশেষ করে সমুদ্রের পানিতে প্লাস্টিক ও অন্যান্য আবর্জনার দূষণ তাকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তোলে।
তিনি বলেন, “এখন প্রায়ই সমুদ্রকে একটি বিশাল আবর্জনার স্তূপের মতো মনে হয়।”
ছোটবেলায় মায়া তার বাবার কাছ থেকে পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে জেনেছিলেন। তার বাবা ছিলেন ব্রাজিলের গ্রিন পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
বাবার কাছ থেকে পাওয়া সেই অনুপ্রেরণা তাকে সমুদ্রের গভীরে টেনে নিয়ে যায়। বর্তমানে তিনি একজন সফল সার্ফার হিসেবে পরিচিত এবং পরিবেশ রক্ষার জন্য কাজ করছেন। ২০২১ সাল থেকে তিনি ‘ওশেনা’ নামক একটি অলাভজনক সংস্থার বোর্ড সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
কোভিড-১৯ মহামারীর সময় তিনি ব্রাজিলের একটি খাদ্য সরবরাহকারী সংস্থাকে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে উৎসাহিত করেছিলেন।
মায়ার যোগাযোগ দক্ষতা ছিল অসাধারণ। তিনি খুব সহজে সাধারণ মানুষের কাছে তার বার্তা পৌঁছে দিতে পারতেন। বর্তমানে তিনি জাতিসংঘের ‘চ্যাম্পিয়ন ফর দ্য ওশান অ্যান্ড ইয়ুথ’ হিসেবে কাজ করছেন।
এই পদে থেকে তিনি তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সমুদ্র এবং পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করেন।
গত বছর মায়া গাবেইরা বড় ঢেউয়ে সার্ফিং থেকে অবসর নিয়েছেন। বর্তমানে তিনি নাজারেতেই বসবাস করেন এবং সমুদ্রের কাছাকাছি সময় কাটান।
বিশাল ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করাটা যে সবসময় আনন্দের ছিল, তা নয়। তবে তিনি সবসময় কিছু একটা খুঁজে ফিরতেন।
সমুদ্রের গভীরতা তাকে সেই সন্ধান দিয়েছে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক