ইউরোপজুড়ে নাশকতামূলক কার্যকলাপের অভিযোগে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আঙুল তুলছেন পশ্চিমা কর্মকর্তারা। ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে গত তিন বছরে সাইবার হামলা, মিথ্যা তথ্য ছড়ানো, এমনকি খুনের ষড়যন্ত্রের মতো ঘটনার সঙ্গে সরাসরিভাবে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। এই ধরনের নাশকতার মূল উদ্দেশ্য হলো ইউরোপীয় দেশগুলোতে বিভেদ সৃষ্টি করা এবং ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন দুর্বল করা।
সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)-এর অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর থেকে এ পর্যন্ত ৫৯টি ঘটনার প্রমাণ মিলেছে, যেখানে সরাসরিভাবে রাশিয়া অথবা তাদের মিত্র দেশ বেলারুশকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে জার্মানিতে গাড়ির ‘টেইলপাইপ’-এ ফোম ঢুকিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে কার্গো বিমানে বোমা রাখার পরিকল্পনা পর্যন্ত।
তাছাড়া, দোকান ও জাদুঘরে আগুন, রাজনীতিবিদ ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে সাইবার হামলা এবং গুপ্তচরবৃত্তির মতো ঘটনাও এর অন্তর্ভুক্ত। ব্রিটেনের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান রিচার্ড মুর এটিকে ‘অত্যন্ত বেপরোয়া কার্যক্রম’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
যদিও রাশিয়ার জড়িত থাকার প্রমাণ দেওয়া কঠিন, তবুও অনেক দেশ প্রকাশ্যে তাদের ওপর দোষ চাপাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের নাশকতামূলক কার্যকলাপের মূল লক্ষ্য হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করা এবং ইউক্রেনকে দুর্বল করা। ন্যাটোর একজন কর্মকর্তা জেমস অ্যাপাথুরাই এই প্রসঙ্গে এপিকে জানান, এর মাধ্যমে নাগরিকদের মধ্যে তাদের সরকারের প্রতি অনাস্থা তৈরি এবং ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
তদন্তের জন্য এপি ১৫ জন বর্তমান সরকারি কর্মকর্তা, বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছে। একইসঙ্গে, তারা বিশেষজ্ঞদেরও মতামত নিয়েছে। এই ঘটনার একটি মানচিত্র তৈরি করেছে এপি, যা হামলার ব্যাপকতা তুলে ধরেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন পরিস্থিতিতে যখন ইউক্রেনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দুর্বল হচ্ছে এবং ইউরোপীয় মিত্ররা ওয়াশিংটনের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, তখন এই ধরনের নাশকতামূলক কার্যকলাপ বিশেষভাবে উদ্বেগজনক।
বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে কিছু ঘটনার ফল মারাত্মক হতে পারতো। যেমন, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যে পাঠানো কিছু প্যাকেজে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল। পশ্চিমা কর্মকর্তারা সন্দেহ করেন, রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত এবং তাদের উদ্দেশ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে যাওয়া কার্গো বিমানে বোমা রাখা।
এছাড়া, জার্মানির একটি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র প্রস্তুতকারক কোম্পানির প্রধানকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগও উঠেছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে।
বাল্টিক সাগরের নিচে থাকা অবকাঠামোতেও ক্ষতির ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে এস্তোনিয়া ও ফিনল্যান্ডকে সংযোগকারী একটি বিদ্যুতের তারও রয়েছে। ফিনল্যান্ড কর্তৃপক্ষ রাশিয়ার একটি জাহাজ আটক করেছে, যেটিকে নিষেধাজ্ঞার আওতা এড়ানোর জন্য ব্যবহৃত ‘ছায়া বহর’-এর অংশ হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে।
ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভুয়া ওয়েবসাইটে যখন নাগরিকদের ইউক্রেন যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল, তখন ফ্রান্সের মন্ত্রী এটিকে রাশিয়ার অপপ্রচার হিসেবে চিহ্নিত করেন।
অন্যদিকে, এস্তোনিয়া, পোল্যান্ড, লাটভিয়া ও ফিনল্যান্ডের কর্মকর্তারা রাশিয়া ও বেলারুশের বিরুদ্ধে তাদের সীমান্তে অভিবাসী পাঠানোর অভিযোগ করেছেন। তবে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ এপিকে বলেছেন, তাদের কাছে এই অভিযোগের কোনো প্রমাণ নেই এবং তারা এই ধরনের অভিযোগ সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরেই তাদের প্রতিপক্ষের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি এবং প্রচারণার মতো কাজ করে আসছে। তবে ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে রাশিয়া আরও ‘সাহসী’ হয়ে উঠেছে। তারা হত্যা ও সাইবার হামলার পাশাপাশি নাশকতামূলক কার্যকলাপ, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে।
এই ধরনের হুমকির মোকাবিলায় সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া এবং গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান করা খুবই জরুরি। বাল্টিক সাগরে সন্দেহজনক নাশকতার প্রতিক্রিয়ায় ন্যাটো ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো রক্ষার জন্য একটি মিশন শুরু করেছে।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস