আর্টিক অঞ্চলের হিমবাহ দ্রুত হারে গলছে, যা বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। সম্প্রতি, নরওয়ের Svalbard দ্বীপে তোলা কিছু ছবি এই পরিবর্তনের প্রমাণ হিসাবে দেখা যাচ্ছে।
ছবিগুলো তুলেছেন সুইডিশ ফটোগ্রাফার ক্রিশ্চিয়ান আসলান্ড। তিনি এক শতাব্দীরও বেশি আগের ছবিগুলোর সঙ্গে বর্তমানের ছবি তুলনা করে দেখিয়েছেন, কীভাবে হিমবাহগুলো দ্রুত তাদের আকার হারাচ্ছে।
আস্লান্ডের তোলা ছবিগুলোতে দেখা যায়, এক সময়ের বিশাল আকৃতির হিমবাহ এখন প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। পুরনো ছবিগুলো ১৯১৮ সালের, যেখানে একটি নৌযান বিশাল এক হিমবাহের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেখা যায়।
আর ২০২২ সালে তোলা ছবিতে একই স্থানে এখন কোনো হিমবাহ নেই, বরং দেখা যাচ্ছে পাথুরে ভূমি।
আস্লান্ড এই কাজটি করেছেন নরওয়েজিয়ান পোলার ইনস্টিটিউট এবং গ্রিনপিসের সহযোগিতায়। তিনি আর্কটিক অঞ্চলের এই পরিবর্তনগুলো নথিবদ্ধ করতে দুইবার, ২০০২ এবং ২০২৪ সালে, ওই অঞ্চলে গিয়েছিলেন।
পুরনো ছবিগুলোর সাথে বর্তমানের ছবি তুলনা করার জন্য তিনি আর্কাইভে সংরক্ষিত ঐতিহাসিক ছবি ব্যবহার করেছেন।
আস্লান্ড জানান, ২০০২ সালে যখন তিনি ছবিগুলো প্রথম প্রকাশ করেন, তখন অনেকেই তাঁর ছবিগুলোকে ‘ফটোশপ করা’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। এমনকি, কেউ কেউ বলেছিলেন, হিমবাহগুলো হয়তো স্বাভাবিকভাবেই তাদের আকার পরিবর্তন করছে, অথবা ছবিগুলো গ্রীষ্মকালে তোলা হয়েছে আর আর্কাইভে থাকা ছবিগুলো শীতকালের।
তবে আস্লান্ড তাদের ভুল প্রমাণ করেন। তিনি বলেন, আর্কাইভে থাকা ছবিগুলোতে সমুদ্রের বরফ বা পর্বতে তুষার নেই, যা শীতকালে থাকার কথা।
ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (NOAA)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সাল থেকে আর্কটিক অঞ্চল পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় দ্বিগুণ দ্রুত গতিতে উষ্ণ হচ্ছে। কোনো কোনো গবেষণা বলছে, এই উষ্ণতা বৃদ্ধির হার আরও বেশি, ১৯৭৯ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী গড় তাপমাত্রার তুলনায় প্রায় চারগুণ বেশি।
একইসঙ্গে, নাসা’র মতে, গ্রীষ্মকালে আর্কটিকে সমুদ্রের বরফ প্রতি দশকে ১২.২% হারে হ্রাস পাচ্ছে।
সমুদ্রের বরফ গলে গেলে তা সূর্যের তাপ প্রতিফলিত করতে পারে না, ফলে সেই তাপ সমুদ্রের পানিতে শোষিত হয়। অন্যদিকে, হিমবাহ গলতে শুরু করলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ে, যা উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে বসবাস করা মানুষের জন্য একটি গুরুতর উদ্বেগের কারণ।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের মেরু অঞ্চলের পর্যবেক্ষণ ও মডেলিং বিভাগের অধ্যাপক জুলিওন স্ট্রোভে বলেন, “উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে দুটোই গলছে।” এছাড়াও, তিনি যোগ করেন, “আর্কটিক মহাসাগরে গত এক শতাব্দীতে বরফের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।”
স্ট্রোভের মতে, “বর্তমানে গ্রীষ্মকালের শেষভাগে যে বরফ দেখা যায়, তা একশ বছর আগের তুলনায় ৪০-৫০% কম। জলবায়ু মডেল এবং পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণাগুলো ইঙ্গিত দেয় যে ২০৫০ সালের মধ্যে আর্কটিকে বরফমুক্ত গ্রীষ্মকাল দেখা যেতে পারে।”
এমনটা ঘটলে তা হবে এক বিরাট পরিবর্তন, যা অন্তত ১ লক্ষ ৩০ হাজার বছর ধরে ঘটেনি। এর ফলস্বরূপ, গ্রিনল্যান্ডের মতো স্থানগুলোতে আরও বেশি বরফ গলতে শুরু করবে এবং সেখানকার পারমাফ্রস্ট (permanently frozen ground) গলে যাবে, যা আর্কটিক মহাসাগরের আশেপাশের জনবসতির জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করবে।
আস্লান্ড জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের ছবিগুলো প্রকাশের পরও তিনি একই ধরনের সমালোচনার শিকার হয়েছেন। তিনি বলেন, “আমি বিস্মিত যে ২০২৪ সালেও মানুষ যা দেখছে, তা বিশ্বাস করতে চাইছে না। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হল, একটি ছবি হাজারো শব্দের চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারে এবং এটি বাস্তব, কিন্তু তারপরও মানুষ এটি বিশ্বাস করতে সমস্যা অনুভব করে।”
আস্লান্ডের আশঙ্কা, “যদি আমরা খুব দ্রুত কোনো পদক্ষেপ না নিই, তবে সম্ভবত ১০ বছরের মধ্যে আমরা যা দেখেছি, তার বেশিরভাগই পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যাবে।”
এই ঘটনাগুলো বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে।
এতে করে একদিকে যেমন মানুষের জীবন ও জীবিকার উপর হুমকি সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যাও বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাব মোকাবিলায় তাই জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
তথ্যসূত্র: CNN