জন র্যান্ডল সেন্টার: নাইজেরিয়ার সংস্কৃতিকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ার বৃহত্তম শহর লাগোসের সংস্কৃতিচর্চার প্রাণকেন্দ্র হলো ওনিকান এলাকা। এখানকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত জন র্যান্ডল সেন্টার ফর ইওরুবা হিস্টোরি অ্যান্ড কালচার, যা ঐতিহ্যবাহী পশ্চিমা ধাঁচের জাদুঘরের ধারণাকে নতুনভাবে উপস্থাপন করছে।
গত বছর অক্টোবরে জনসাধারণের জন্য খোলা হয় এই কেন্দ্রটি। এর প্রধান লক্ষ্য হলো, ইওরুবা সংস্কৃতির একটি প্রাণবন্ত চিত্র তুলে ধরা, যা নাইজেরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি।
ঐতিহ্যবাহী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে পরিচিত নাইজেরিয়ান ন্যাশনাল মিউজিয়ামের ঠিক বিপরীতেই গড়ে উঠেছে এই অত্যাধুনিক কেন্দ্রটি।
এখানকার প্রধান স্থপতি সিউন ওডুওলে বলেন, “ঐতিহ্যবাহী জাদুঘরগুলো সংস্কৃতির প্রতি একটা বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দেয়, কিন্তু আমরা চেয়েছি এটিকে উদযাপন করতে।”
১৯২০-এর দশকে সিয়েরা লিওনের এক স্থানীয় চিকিৎসক জন র্যান্ডলের অর্থায়নে এখানে একটি সুইমিং পুল তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে নাইজেরিয়ার মানুষ সাঁতার শিখতে পারত।
জন র্যান্ডল সেন্টারের বর্তমান কাঠামো সেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে ধারণ করে।
ব্রিটিশ শিল্পী ও ইওরুবা ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ ড. উইল রিয়া এই প্রকল্পের প্রধান পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন।
তাঁর মতে, এই কেন্দ্রটি প্রমাণ করে যে নাইজেরিয়াও উন্নত মানের জাদুঘর তৈরি করতে পারে, যা আফ্রিকার সংস্কৃতিকে পশ্চিমা জাদুঘরের গতানুগতিক উপস্থাপনা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
পশ্চিমা জাদুঘরগুলোতে আফ্রিকার সংস্কৃতিকে সাধারণত একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং অনুজ্জ্বল রূপে দেখানো হয়। সেখানে অনেক কিছুই কাঁচের বাক্সে আবদ্ধ থাকে, যা দর্শকদের সহজে অনুভব করার সুযোগ দেয় না।
কিন্তু লাগোসের রাস্তায় বা ইকোলে-র (দক্ষিণ-পশ্চিম নাইজেরিয়ার একটি শহর) মানুষের জীবনযাত্রা এর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
আমরা চেয়েছিলাম এমন একটি স্থান তৈরি করতে, যেখানে বর্ণ, শব্দ এবং জীবনের স্পন্দন থাকবে—পশ্চিমা ধাঁচের নিস্তব্ধ জাদুঘরের থেকে যা হবে সম্পূর্ণ আলাদা,” যোগ করেন রিয়া।
এই প্রকল্পের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, জাদুঘরের প্রদর্শনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করা।
তাই ওডুওলে, রিয়া এবং তাঁদের দল নাইজেরিয়া ও আন্তর্জাতিক জাদুঘরগুলোতে ছড়িয়ে পড়েন ইওরুবা সংস্কৃতির নিদর্শন খুঁজে বের করার জন্য।
অনেক মূল্যবান শিল্পকর্ম কেনার সামর্থ্য তাঁদের ছিল না, তাই বিভিন্ন জাদুঘরের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী ঋণের ব্যবস্থা করা হয়।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ব্রিটিশ মিউজিয়ামের সঙ্গে একটি চুক্তি, যার মাধ্যমে ‘ল্যান্ডার স্টুল’ নামক একটি কাঠের কারুকার্য করা চেয়ার দীর্ঘ সময়ের জন্য এখানে প্রদর্শনের জন্য আনা হয়েছে।
জাদুঘরের প্রদর্শনী স্থানকে চারটি প্রধান অংশে ভাগ করা হয়েছে।
এর একটি অংশে ইওরুবাদের প্রাচীন ইতিহাস ও মিথগুলোকে তুলে ধরা হয়েছে।
দর্শকদের জন্য আধুনিক রীতিনীতি ও সংস্কৃতির একটি যাত্রা এবং ভবিষ্যৎ ইওরুবা সংস্কৃতির ধারণা দেওয়া হয়েছে।
এখানে বিভিন্ন ইন্টারেক্টিভ সুযোগও রয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, প্রখ্যাত শিল্পী ও অভিনেতা জিমি সোলানকের কণ্ঠে শিশুদের জন্য বলা কিছু গল্প রেকর্ড করে শোনানো হয়, যা ইওরুবা গ্রামের প্রথাগত পরিবেশের কথা মনে করিয়ে দেয়।
দর্শকদের জন্য রয়েছে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে ইগুণগুণ মাস্ক পরিহিত মানুষের প্রতিচ্ছবিতে নিজেদের রূপান্তরিত করার সুযোগ।
ইওরুবাদের দেবতা, যেমন: বজ্রের দেবতা শাঙ্গোকে সুপারহিরোর মতো উপস্থাপন করা হয়েছে।
জাদুঘরের সর্বত্র ইওরুবা ভাষায় লেখা রয়েছে, তার নিচে ছোট হরফে ইংরেজি অনুবাদ দেওয়া হয়েছে।
ওডুওলের মতে, এই কেন্দ্রের মূল উদ্দেশ্য হলো, ইওরুবা সংস্কৃতিকে বিশেষভাবে তুলে ধরা।
এমনকি এর স্থাপত্যেও সেই সংস্কৃতির ছাপ স্পষ্ট।
যেমন, মেঝেতে ব্যবহৃত হয়েছে বালু ও নুড়ির মতো উপাদান, যা ইওরুবা গ্রামের মাটির কথা মনে করায়।
ছাদের কারুকার্য করা হয়েছে কাঠ দিয়ে, যা ইফা নামক একটি ভবিষ্যৎকথন পদ্ধতির প্রতীক।
এই কেন্দ্রের সবুজ ছাদযুক্ত ঢালু কাঠামো ইওরুবাদের জীবনচক্রের ধারণা দেয়।
সব মিলিয়ে, জন র্যান্ডল সেন্টার বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ইওরুবা সম্প্রদায়ের জন্য একটি গর্বের স্থান, যেখানে তাঁরা তাঁদের সংস্কৃতিকে অনুভব করতে পারবেন।
তথ্য সূত্র: সিএনএন