যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য শুল্ক নীতির কারণে ভারতের ইস্পাত শিল্পে যে প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়ে এখন আলোচনা চলছে। দেশটির অনেক ছোট কারখানায় তৈরি হওয়া ইস্পাত পণ্যের দাম কমে আসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, যদিও এর বিপরীত চিত্রও বিদ্যমান। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বাজারেও এর কিছু প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
ভারতের বেঙ্গালুরুর আশেপাশে অবস্থিত কারখানাগুলোতে তৈরি হওয়া ইস্পাত থেকে বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য শুল্ক আরোপের ঘোষণার কারণে চীনের মতো দেশগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করা কঠিন হয়ে পড়বে। ফলে, তারা ভারতের বাজারে সস্তায় ইস্পাত সরবরাহ করতে পারে। এতে করে, ভারতের ছোট ইস্পাত প্রস্তুতকারকদের ব্যবসা লাভের সম্ভাবনা বাড়বে। উদাহরণস্বরূপ, সান টেকপ্রো ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বি. প্রবীণের কথা বলা যায়, যিনি ইস্পাত থেকে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করেন। শুল্কের কারণে ইস্পাতের দাম কমলে তাঁর ব্যবসার মুনাফা বাড়বে। এই ধরনের ব্যবসায়ে ভারতের প্রায় ২০ কোটির বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয় এবং এটি ভারতের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
তবে, সস্তা ইস্পাত সবার জন্য সুখবর নয়। ভারতের ইস্পাত প্রস্তুতকারকদের সংগঠন, ইন্ডিয়ান স্টিল অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নবীন জিন্দাল এই পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। কারণ, ভারত বর্তমানে এমন একটি প্রধান বাজার যেখানে কোনো বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা নেই। ফলে, এখানে অন্য দেশগুলো সহজে তাদের পণ্য সরবরাহ করতে পারবে। এছাড়া, ভারতের নিজস্ব ইস্পাত শিল্পকে আরো পরিবেশবান্ধব করার যে চেষ্টা চলছে, তাতেও এই পরিস্থিতি প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ, বর্তমানে ভারতে কয়লাভিত্তিক চুল্লি ব্যবহার করে ইস্পাত তৈরি করা হয়, যা থেকে প্রচুর পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়।
বর্তমানে ভারতের ইস্পাত শিল্প বেশ বড় এবং এর উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। আগামী পাঁচ বছরে দেশটির ইস্পাত উৎপাদন ১২০ মিলিয়ন টন থেকে ৩০০ মিলিয়ন টনে পৌঁছানোর পরিকল্পনা রয়েছে। পরিবেশ গবেষণা সংস্থা ‘গ্লোবাল এনার্জি মনিটর’-এর তথ্য অনুযায়ী, ইস্পাত তৈরির কারণে ভারতের কার্বন নিঃসরণ হয়, যা দেশটির মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের প্রায় ১২ শতাংশ। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী উৎপাদন বাড়লে এই হার দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চীন, ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ভারতীয় ইস্পাত প্রস্তুতকারকরা এখনো প্রধানত কয়লা ভিত্তিক ‘ব্লাস্ট ফার্নেস’ ব্যবহার করেন। এই কারণে তাদের কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বেশি হয়। ইউরোপীয় কার্বন বর্ডার অ্যাডজাস্টমেন্ট মেকানিজম (CBAM) নামক একটি নতুন নীতির কারণে ভারতের ইস্পাত রপ্তানিতে সমস্যা হতে পারে। এই নীতির অধীনে, আগামী বছর থেকে ইউরোপে কার্বন নিঃসরণ করে উৎপাদিত পণ্যের উপর কর আরোপ করা হবে।
ভারত সরকার ২০৭০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। একইসঙ্গে, ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০০ গিগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছে দেশটি। সম্প্রতি, ভারত সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে ১০০ গিগাওয়াটের মাইলফলক অতিক্রম করেছে।
ভারতের ইস্পাত প্রস্তুতকারকরাও পরিবেশ সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন, তবে এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থান করা নিয়ে তাঁদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে।
ভারতের এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য কিছু সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে, ইস্পাতের দাম কমে গেলে দেশের নির্মাণ ও অবকাঠামো খাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে, বিশ্ববাজারে ভারতের ইস্পাত শিল্পের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা কমে গেলে, বাংলাদেশের আমদানি-নির্ভরতা বেড়ে যেতে পারে।
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস