যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত : কিয়ামতের ঘণ্টা নাকি সাময়িক অচলাবস্থা?
গত তিন বছর ধরে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিয়ে আসা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সাহায্য বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ইউক্রেনের জন্য এটি একটি বড় ধাক্কা, তবে দেশটির প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে কিনা, সেই বিষয়ে এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের কারণ, এর প্রভাব এবং অন্যান্য মিত্রদের ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
রাশিয়া ২০২২ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র কিয়েভকে সবচেয়ে বেশি সামরিক সহায়তা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত দেশটি ইউক্রেনকে ১৮০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সহায়তা করেছে, যার মধ্যে সামরিক সহায়তা ছিল প্রায় ৬৬.৫ বিলিয়ন ডলার। এই সাহায্যের পরিমাণ ইউক্রেনের সামরিক সরঞ্জামের প্রায় ২০ শতাংশ। এর মধ্যে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা রাশিয়ার শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করতে সক্ষম। শুধু অস্ত্রশস্ত্রই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া স্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থা ‘স্টারলিঙ্ক’ ব্যবহার করে ইউক্রেনীয় সেনারা যুদ্ধক্ষেত্রে যোগাযোগ রক্ষা করে। এছাড়া, মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য ব্যবহার করে তারা রাশিয়ার সেনা সরঞ্জামের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে এবং আক্রমণের লক্ষ্য নির্ধারণ করে।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা বন্ধ হলে ইউক্রেনের সামরিক সক্ষমতায় বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে, স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া তথ্য আদান-প্রদান বন্ধ হয়ে গেলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পাল্টা আঘাত হানতে কিয়েভের জন্য কঠিন হবে। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের এই সহায়তা স্থগিতের কারণ হিসেবে হোয়াইট হাউজ জানিয়েছে, তারা ইউক্রেনকে দেওয়া সাহায্য পর্যালোচনা করতে চায় এবং দেখতে চায় যে, এই সহায়তা যুদ্ধের সমাধানে কতটা কাজে লাগছে। এছাড়া, ইউক্রেন রাশিয়া সঙ্গে শান্তি আলোচনার ব্যাপারে কতটা আগ্রহী, সেটিও তারা বিবেচনা করতে চাইছে।
সম্প্রতি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভেন্সের একটি বৈঠকের পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকে ট্রাম্প ও ভেন্স অভিযোগ করেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের জন্য যথেষ্ট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেননি।
যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধের ফলে তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে হয়তো তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না, কারণ ইউক্রেনীয় বাহিনী বর্তমানে পূর্বাঞ্চলে রাশিয়ার আক্রমণ প্রতিহত করতে চেষ্টা করছে। তবে, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দূরপাল্লার লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার ক্ষমতা কমতে পারে। রাশিয়ার সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা স্থগিত ইউক্রেনের জন্য “অসুবিধাজনক, তবে মারাত্মক নয়”। তাদের মতে, ইউরোপীয় মিত্ররা কিছু আর্টিলারি সরবরাহ করতে পারলেও, যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার বিকল্প তাদের কাছে নেই।
তবে, ইউক্রেনীয় বাহিনী ইতোমধ্যেই আর্টিলারি শেল এবং অন্যান্য সামরিক সরঞ্জামের মজুত তৈরি করেছে। তারা এখন ড্রোন উৎপাদন বাড়িয়েছে, যা যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। ধারণা করা হয়, বর্তমানে ইউক্রেনীয় বাহিনী যে সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করছে, তার অর্ধেকের বেশি দেশেই তৈরি।
অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা ৫ হাজার আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করতে ২ বিলিয়ন পাউন্ড (প্রায় ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা) ব্যবহার করবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও তাদের সদস্য দেশগুলোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে এবং ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিতে ৮৪০ বিলিয়ন ইউরোর (প্রায় ৯৯ লক্ষ কোটি টাকা) একটি পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক থিংক ট্যাংক ‘চ্যাথাম হাউজ’-এর পরিচালক সামির পুরীর মতে, ইউরোপ ও আমেরিকার সহায়তা একে অপরের সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, “এটি সবসময় একটি যৌথ প্রচেষ্টা ছিল। যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেয়, ইউরোপীয় দেশগুলোও দেয়। যুক্তরাষ্ট্র যদি এই যৌথ প্রচেষ্টা থেকে সরে আসে, তবে কাঠামোর একটি বিশাল অংশ অনুপস্থিত থাকবে।”
যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত ইউক্রেনকে সামরিক দিক থেকে দুর্বল করতে পারে। তবে, দেশটির টিকে থাকার সম্ভাবনা এখনো রয়েছে, কারণ তারা নিজস্ব উৎপাদন বাড়িয়েছে এবং প্রতিরক্ষার নতুন কৌশল তৈরি করছে। এখন দেখার বিষয়, ইউরোপীয় দেশগুলো এবং অন্যান্য মিত্ররা ইউক্রেনকে কতটা সাহায্য করতে পারে। এই সামরিক সহায়তা স্থগিতের ফলে বিশ্ব রাজনীতিতে যে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি হবে, তা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি উদ্বেগের বিষয়।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস