বাংলার প্রবীণদের স্বাস্থ্য নিয়ে এক যুগান্তকারী গবেষণা
বয়সকে হার মানিয়ে শারীরিক সক্ষমতা অর্জনের এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন শহরের ‘হিব্রু রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার ফর দ্য এজেড’-এর প্রবীণ নাগরিকেরা। ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে, এই কেন্দ্রে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে নব্বই বছর বয়সী মানুষেরাও তাদের হারানো শক্তি ফিরে পেতে পারেন। এই গবেষণার ফল শুধু চিকিৎসা বিজ্ঞানকে নতুন দিশা দেখায়নি, বরং প্রবীণদের জীবনযাত্রায় এনেছে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন।
গবেষণাটি পরিচালনা করেন তরুণ চিকিৎসক মারিয়া ফিয়াতারোনি। সেই সময়, চিকিৎসা জগতে প্রচলিত ধারণা ছিল—বয়স্ক মানুষের পক্ষে ভারী ব্যায়াম করা সম্ভব নয়। কারণ, এতে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। কিন্তু ফিয়াতারোনি এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেন। তিনি প্রমাণ করেন যে, উচ্চ তীব্রতার ব্যায়ামের মাধ্যমে বয়স্ক মানুষের পেশী শক্তিশালী করা সম্ভব।
গবেষণায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের গড় বয়স ছিল ৮৮ বছর। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন নারী। প্রায় সবাই একাধিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছিলেন। দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক কাজকর্ম—যেমন বিছানা থেকে ওঠা, বাথরুমে যাওয়া, এমনকি হাঁটাচলার জন্যও তাঁদের অন্যের সাহায্য নিতে হতো। কিন্তু তাঁদের জীবন ছিল সংগ্রামের, যাঁর মধ্যে কেউ হয়তোবা কাটিয়েছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা, আবার কেউবা দেখেছেন দেশভাগের কষ্ট।
গবেষণার জন্য নির্বাচিত ১০ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে হাঁটু বাঁকানো (Knee Extension) ব্যায়াম করতে দেওয়া হয়। এই ব্যায়ামে চেয়ারে বসে পায়ের পেশী ব্যবহার করে ওজন উঠানো-নামানো হতো। প্রথম দিকে, তাঁদের প্রত্যেকের সর্বোচ্চ ক্ষমতার ৫০ শতাংশ ওজনের ব্যায়াম করতে দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে, এই ওজন বাড়িয়ে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত নেওয়া হয়। ব্যায়ামের ফলে তাঁদের পেশী দ্রুত শক্তিশালী হতে শুরু করে। ফলে, নিয়মিত বিরতিতে তাঁদের ব্যায়ামের ক্ষমতা পরীক্ষা করা হতো, যাতে তাঁরা তাঁদের সর্বোচ্চ ক্ষমতার কাছাকাছি ওজন ব্যবহার করতে পারেন।
আট সপ্তাহ ধরে চলা এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের শারীরিক সক্ষমতায় অভাবনীয় উন্নতি দেখা যায়। কারো কারো ক্ষেত্রে শক্তি কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। তাঁদের হাঁটার গতিও বেড়েছিল প্রায় ৫০ শতাংশ। শুধু তাই নয়, তাঁদের পেশী আকারেও বৃদ্ধি পায়।
এই গবেষণার ফল ১৯৯০ সালে ‘জার্নাল অফ দ্য আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন’-এ প্রকাশিত হয়। যা চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। গবেষণায় দেখা যায়, এই প্রবীণদের পেশী বৃদ্ধির হার, কম বয়সী মানুষের ব্যায়ামের ফলে পেশী বৃদ্ধির হারের কাছাকাছি ছিল।
ফিয়াতারোনির এই গবেষণা প্রবীণদের স্বাস্থ্য এবং শরীরচর্চা সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা বদলে দেয়। প্রমাণ হয়, বয়স বাড়লেও, সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শারীরিক শক্তি ও কার্যকারিতা বাড়ানো সম্ভব। এই গবেষণার ফলস্বরূপ, হিব্রু রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে ব্যায়াম একটি নিয়মিত সংস্কৃতিতে পরিণত হয়।
গবেষণার ফল বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই গবেষণা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশেও বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। শারীরিক দুর্বলতা ও স্বাস্থ্য বিষয়ক জটিলতা তাঁদের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তোলে। তাই, এই গবেষণা থেকে পাওয়া ধারণা কাজে লাগিয়ে, প্রবীণদের জন্য উপযুক্ত ব্যায়ামের ব্যবস্থা করা গেলে, তাঁদের জীবন আরও উন্নত করা সম্ভব।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান