বদহজম রোগের কারণে জীবন-যুদ্ধে জয়ী এক নারীর গল্প
ছোটবেলা থেকেই খাবার ছিল আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মায়ের হাতের রান্না করা খাবার, বিশেষ করে ছুটির দিনের বিশেষ আয়োজন, এখনো যেন চোখের সামনে ভাসে। পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে বসে খাবার খাওয়ার আনন্দটাই ছিল অন্যরকম। কিন্তু ১২ বছর বয়সে যখন ক্রোনস রোগ ধরা পড়ল, তখন যেন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। পেটে অসহ্য যন্ত্রণা, ঘন ঘন বাথরুম যাওয়া, আর খিদে কমে যাওয়া—এগুলো ছিল রোগের প্রাথমিক লক্ষণ। ধীরে ধীরে শরীরের ওজন কমতে শুরু করল, ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে গেল, শরীরে কোনো শক্তিও খুঁজে পেতাম না। খাবারের প্রতি আকর্ষণটা যেন দিন দিন কমতে লাগল। আগে যেখানে রান্নার অনুষ্ঠান দেখলে খুশি হতাম, সেখানে এখন কান্না পেত। শরীরে কিছুই যেন সহ্য হতো না, কেবল বিশেষ ধরনের পানীয় ছাড়া, যেগুলোর স্বাদ ছিল তেতো। ধীরে ধীরে আমি দুর্বল হয়ে যাচ্ছিলাম, এটা আমাকে ভীত করে তুলেছিল।
১৬ বছর বয়সে আমার বৃহৎ অন্ত্র (colon) অস্ত্রোপচার করে বাদ দেওয়া হলো, যাতে রোগটি শরীর থেকে নির্মূল করা যায়। কিন্তু ১৮ বছর হওয়ার পরেই রোগটি আবার ফিরে আসে, এবার আরও ভয়ংকর রূপে। একদিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরার পথে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি, শরীর এতটাই দুর্বল হয়ে গিয়েছিল যে সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারছিলাম না। এরপর নিউ ইয়র্কে ছুটি কাটাতে গিয়েও একই ঘটনা ঘটল। বাথরুম থেকে বের হওয়ার জো ছিল না, আর সবসময় যন্ত্রণায় কাতর থাকতাম। মনে হচ্ছিল, জীবনটা যেন একঘেয়ে হয়ে গেছে।
অবশেষে, আমার জীবনে পরিবর্তন আনার প্রয়োজন ছিল। ২৩ বছর বয়সে, ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নিলেন আমার সম্পূর্ণ অন্ত্র, মলাশয় এবং পায়ুপথ অপসারণ করতে হবে এবং একটি স্থায়ী “ইলেওস্টোমি” তৈরি করতে হবে। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আমার ক্ষুদ্রান্ত্র থেকে একটি অংশ বের করে এনে পেটের সঙ্গে যুক্ত করা হয়, যার মাধ্যমে বর্জ্য একটি ব্যাগে জমা হতে থাকে। সাধারণত, এই অস্ত্রোপচারটি দুটি ধাপে করা হয়, কিন্তু আমার শারীরিক দুর্বলতার কারণে একবারই সব করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। অস্ত্রোপচারের পর সুস্থ হতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। পেটে সংক্রমণ হলো, এবং অস্ত্রোপচারের ক্ষত আবার ফেটে গেল। কয়েক মাস ঘরবন্দী থাকতে হয়েছিল আমাকে।
হাসপাতাল থেকে দুই সপ্তাহ পর যখন বাড়ি ফিরলাম, তখন শরীর দুর্বল থাকলেও, খাবার খাওয়ার অনুমতি পেলাম। প্রথম খাবার হিসেবে আমি আলু সেদ্ধ খেলাম, সাথে ছিল পনির। সেই স্বাদ এখনো ভুলতে পারি না।
শারীরিক সুস্থতার সময়, ডাক্তাররা আমাকে বিশ্রাম নিতে এবং প্রচুর খাবার খেতে বলেছিলেন। এটাই ছিল আমার জন্য সবচেয়ে ভালো পরামর্শ। এরপর আমার দিনগুলো খাবারের সঙ্গেই বাঁধা হয়ে গেল। সকালের নাস্তা, দুপুরে হালকা খাবার, তারপর দুপুরে ঘুম এবং রাতের খাবার—এভাবেই চলত আমার জীবন। আমার বাবা-মা আমাকে আবার খেতে দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন।
আমি যত বেশি খেতাম, তত বেশি শক্তিশালী হতাম। ধীরে ধীরে আমার শরীরে ক্ষত ভালো হতে শুরু করলো। সাপ্লিমেন্টারি পানীয়র বদলে আমি এখন পেট ভরে পছন্দের খাবার খেতাম—মাংস, কাস্টার্ড (মিষ্টি দই-এর মতো), পাস্তা, পিৎজা, আইসক্রিম—যেন জীবন ফিরে পেলাম। আমার জীবন স্বাভাবিক হলো, এবং খাবারের প্রতি আকর্ষণও ফিরে এলো।
আমার বয়স যখন ২৪, তখন আমি আমার স্বামীর সঙ্গে পরিচিত হই। সেই সময় আমি আমার নতুন জীবন এবং “ইলেওস্টোমি” নিয়ে মানিয়ে নিচ্ছিলাম। আমি তাকে আমার শারীরিক অবস্থার কথা জানাতে কিছুটা নার্ভাস ছিলাম, তবে সে আমাকে খুব ভালোভাবে বুঝেছিল। আমরা একসঙ্গে রান্না করা এবং নতুন খাবার চেখে দেখতে ভালোবাসতাম। মাঝেমধ্যে আমরা নিজেরাই পিৎজা বানাতাম, রেসিপি চেষ্টা করতাম, রেস্টুরেন্টে গিয়ে নতুন খাবারের স্বাদ নিতাম। একবার আমরা প্রি-টজেল (এক ধরনের বেকারি আইটেম) বানানোর চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সেটা ভালো হয়নি, তবুও আমরা সেটা খেয়েছিলাম।
বর্তমানে, অস্ত্রোপচারের জায়গায় কিছু টিস্যু জমে যাওয়ায় আমার খাদ্য তালিকায় কিছু বিধিনিষেধ এসেছে। আমি এখন চিপস, বেকন, কাঁচা ফল বা সবজি খেতে পারি না, কারণ আমার অন্ত্র কিছুটা সরু হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে হয়তো আরও কিছু খাবার তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। কিন্তু এখনো অনেক খাবার আছে যা আমি উপভোগ করি। অস্ত্রোপচারের ১৬ বছর পরেও, আমি আমার জীবন ফিরে পাওয়ার জন্য কৃতজ্ঞ।
ছোটবেলায় যখন আমার দিদার সঙ্গে ডিনারে যেতাম, তখন তিনি সবসময় দুটি ডেজার্ট অর্ডার করতেন, কারণ যুদ্ধের সময় চিনি রেশন করা হতো। এখন যেহেতু তিনি ইচ্ছামতো চিনি খেতে পারেন, তাই একটি মুহূর্তও নষ্ট করতে চান না। আমি এখন সেই মানসিকতা বুঝি। খাবার খাওয়ার এবং উপভোগ করার ক্ষমতা হারানোর পর, আমি যখন তা ফিরে পেয়েছি, তখন আর কোনো কিছুই হালকাভাবে নিতে চাই না। আমি একটি সুষম খাবারের গুরুত্ব বুঝি, তবে নিজেকে কোনো পছন্দের খাবার থেকে বঞ্চিত করি না।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান