যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের মধ্যে সম্পর্ক যখন গভীর সংকটে, তখন তা পুনরুদ্ধারে এগিয়ে আসে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। বিশেষ করে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাশিয়া-ঘেঁষা নীতির কারণে যখন ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া হয়, সেই পরিস্থিতিতে এই দুই দেশের কূটনীতিকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল, যেকোনো মূল্যে ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা।
ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে হওয়া একটি বৈঠককে কেন্দ্র করে সম্পর্কের অবনতি হয়। ওই বৈঠকে ট্রাম্প জেলেনস্কিকে সরাসরি ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি দুর্বলতা দেখানোর জন্য অভিযুক্ত করেন। এরপরই তিনি ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দেন এবং গোয়েন্দা তথ্য দেওয়াও স্থগিত করেন। ইউরোপের অনেক কূটনীতিক মনে করেন, এই বৈঠক ছিল জেলেনস্কিকে অপমান করার একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। জার্মানির একজন শীর্ষ নেতা ট্রাম্পের এই পদক্ষেপকে ‘পরিকল্পিত উত্তেজনা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কেইর স্টারমার ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর উদ্যোগে ২ মার্চে একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মূলত ওয়াশিংটন সফরের ফলাফল নিয়ে আলোচনার জন্য এই বৈঠকের আয়োজন করা হলেও, পরে তা সংকট মোকাবিলার একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চে পরিণত হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ইউক্রেনের মূল্যবান খনিজ সম্পদের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার যে চেষ্টা চলছিল, তা সম্পর্ক ভাঙনের আসল কারণ নয়। বরং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মূল চাওয়া ছিল, জেলেনস্কি যেন শান্তির ব্যাপারে আন্তরিকতা দেখান।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ প্রস্তাব দেন, ইউক্রেন যেন এক মাসের জন্য যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাঁ-নয়েল বারো এই প্রস্তাবের ব্যাখ্যা করে বলেন, বিমান, সমুদ্র ও জ্বালানি অবকাঠামোর ওপর এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা হলে, পুতিন আলোচনার টেবিলে বসতে রাজি হন কি না, তা বোঝা যাবে। এর মাধ্যমে সত্যিকারের শান্তি আলোচনার পথ খুলতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত পিটার ম্যান্ডেলসনও এই প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানান। তিনি বলেন, ইউক্রেনের উচিত অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া দেখা। একই সঙ্গে ইউরোপীয় দেশগুলোকেও এই যুদ্ধবিরতির আহ্বানে সমর্থন দিতে হবে।
তবে ওয়াশিংটনে ইউক্রেনের প্রতি অসন্তোষ ছিল তীব্র। রিপাবলিকানরা জেলেনস্কিকে যুক্তরাষ্ট্রের টিভিতে এসে ট্রাম্পের কাছে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানান।
৪ মার্চ ট্রাম্প ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা স্থগিত করেন এবং এর পরের দিন গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানও বন্ধ করে দেন। এর প্রতিক্রিয়ায় ইউরোপীয় দেশগুলোতে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশ চিফ অফ দ্য ডিফেন্স স্টাফ অ্যাডমিরাল স্যার টনি রাডাকিনসহ অনেকে ওয়াশিংটনে গিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন, ইউক্রেনকে এভাবে ত্যাগ করা উচিত হবে না।
৬ মার্চের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র জানায়, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট সৌদি আরবে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে রাজি হয়েছেন এবং যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছাতে পারেন। এর মাধ্যমে ওয়াশিংটন সম্ভবত বুঝতে পেরেছিল, ইউক্রেনীয় নেতা তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছেন।
ট্রাম্প অবশ্য রবিবার এক সাক্ষাৎকারে জেলেনস্কিকে ‘চতুর এবং কঠোর’ ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করেন। তবে তিনি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ নন বলেও জানান।
পরিস্থিতি বিবেচনায় কেইর স্টারমার, ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ও ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুটের মধ্যে আলোচনা হয়। স্টারমার মনে করতেন, সামরিক সহায়তা ও গোয়েন্দা তথ্য বন্ধ করা ছিল ট্রাম্পের একটি কৌশল, যার মাধ্যমে তিনি জেলেনস্কিকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করাতে চেয়েছিলেন।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জোনাথন পাওয়েলও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনার মূল বিষয় ছিল, সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের তত্ত্বাবধানে জেদ্দায় হতে যাওয়া বৈঠকে কীভাবে আলোচনাগুলো পরিচালনা করা হবে।
সংক্ষেপে, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের কূটনীতিকরা ইউক্রেন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চেষ্টা চালিয়ে যান। তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল, রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলে আনতে ট্রাম্পের ওপর চাপ সৃষ্টি করা।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান