ইউরোপের এক অসাধারণ গন্তব্য: ক্যাটালোনিয়ার ভ্যাল ডি’আরাঁ-এ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা
পশ্চিম ক্যাটালোনিয়ার পিরেনিস পর্বতমালায় অবস্থিত ভ্যাল ডি’আরাঁ- প্রকৃতির এক অপরূপ লীলাভূমি। ফ্রান্সের সীমান্ত ঘেঁষে বরফের চাদরে মোড়া পাহাড়, সবুজ বনভূমি, স্বচ্ছ নীল হ্রদ আর খরস্রোতা নদীর এই উপত্যকা অ্যাডভেঞ্চার প্রেমীদের জন্য এক স্বর্গরাজ্য। যারা প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে চান, তাদের জন্য ভ্যাল ডি’আরাঁ হতে পারে একটি আদর্শ স্থান। এখানে শীতকালে স্কিইং এবং গ্রীষ্মকালে হাইকিং-এর মতো নানান অভিজ্ঞতার সুযোগ রয়েছে।
ভ্যাল ডি’আরাঁ-এর পর্বত সংকুল অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে ঐতিহ্যপূর্ণ গ্রাম, যা এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতির সাক্ষী। এখানকার স্থানীয় ভাষা হলো আরানেস, যা এই অঞ্চলের সংস্কৃতিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। এখানকার স্থানীয় রেস্তোরাঁগুলোতে পরিবেশিত হয় মৌসুমি উপাদান সমৃদ্ধ খাবার, যা ভ্যাল ডি’আরাঁ-এর রন্ধনশৈলীর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আসুন, জেনে নেওয়া যাক এই অঞ্চলের কিছু বিশেষত্ব-
অ্যাডভেঞ্চারের ভিন্ন স্বাদ:
শীতকালে ভ্যাল ডি’আরাঁ-এর প্রধান আকর্ষণ হলো এখানকার বিশাল স্কি রিসোর্ট, বেইকুইরা বেরেত। এখানে ১০০ মাইলের বেশি বিস্তৃত স্কিইং-এর পথ রয়েছে, যা স্কিয়ার ও স্নোবোর্ডারদের জন্য এক দারুণ সুযোগ। যারা অফ-পিস্ট স্কিইং ভালোবাসেন, তাদের জন্য এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ চমৎকার। শীতের সময় আটলান্টিক উপকূল থেকে আসা তুষারপাতের কারণে এখানে বরফের স্তর থাকে পুরু। এছাড়াও, ফ্রিস্টাইল স্কিয়ারদের জন্য রয়েছে এর্যা মারমতা স্নো পার্ক। শুধু স্কিইংই নয়, তুষারে আচ্ছাদিত প্রান্তরে স্নোশু, টবগান বা হাস্কি-চালিত স্লেজে চড়ার মতো অভিজ্ঞতাও উপভোগ করা যায়।
গ্রীষ্মকালে, ভ্যাল ডি’আরাঁ-এর দৃশ্যপট সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়ে যায়। সবুজ ঘাস আর নানা রঙের ফুলের সমাহার মন মুগ্ধ করে তোলে। এই সময় হাইকিং বা মাউন্টেন বাইকিং-এর জন্য আদর্শ। আল্ট পিরিনু ন্যাচারাল পার্ক এবং আইগুয়েস্টোর্তেস এবং এস্ট্যানি ডি স্যান্ট মাউরিচি ন্যাশনাল পার্কের পথ ধরে হেঁটে যাওয়া এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। বন্যপ্রাণী দেখার সুযোগও রয়েছে, যেমন – শ্যা্মোইস, মারমট, হরিণ এবং বিরল ভালুক।
যারা একটু বেশি অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসেন, তারা এখানকার ভায়া ফেরারাতা-র মতো দুর্গম পথে আরোহণ করতে পারেন। বাগার্গুয়ের কাছে অবস্থিত পোই দে উনহা ভায়া ফেরারাতা-টি প্রায় আধ মাইল দীর্ঘ, যেখানে তিব্বতি সেতু এবং খাড়া পাথরের দেয়ালের উপর ল্যাডার স্থাপন করা হয়েছে। স্থানীয় গাইডরা এখানে আরোহণের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। এছাড়াও, গ্যারন নদীর জলে ক্যানিয়নিং, রাফটিং এবং হাইড্রোস্পিডিং-এর মতো কার্যকলাপও করতে পারেন। রাতের আকাশে তারা দেখতে ভালোবাসলে, এখানে স্টারগেজিং-এরও ব্যবস্থা আছে।
ঐতিহ্যপূর্ণ গ্রাম ও সংস্কৃতি:
ভ্যাল ডি’আরাঁ-এর সংস্কৃতি এখানকার গ্রামগুলোতে আজও গভীরভাবে প্রোথিত। এখানকার ৩৩টি গ্রাম পর্যটকদের কাছে এক ভিন্ন আকর্ষণ। বাগার্গুয়ে গ্রামটি এর মধ্যে অন্যতম। পাথরের তৈরি বাড়ি, সরু গলি এবং বারান্দায় ফুলের টবে সজ্জিত এই গ্রামটি গ্রীষ্মকালে পর্যটকদের মন জয় করে নেয়।
বাগার্গুয়ে, গ্যারোস ও আর্তিয়েস-এর মতো গ্রামগুলি স্পেনের সবচেয়ে সুন্দর গ্রামগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাগার্গুয়েতে, পর্যটকেরা স্থানীয় “হোরমাতেজ তারাউ” নামক দুগ্ধ কেন্দ্রে তৈরি ঐতিহ্যবাহী আরানেস পনিরের স্বাদ নিতে পারেন। এখানকার গাইড ট্যুরগুলি ব্রোঞ্জ যুগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত উপত্যকার ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা দেয়। আপনি যদি একটু ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন, তাহলে সান্টা মারিয়া ডি আর্টিয়েস-এর রোমানেস্ক-গথিক চার্চ, যেখানে পাঁচ তলা বিশিষ্ট ঘণ্টাঘর এবং সুন্দর ফ্রেস্কো রয়েছে, তা দেখতে পারেন। ভিয়েলহা শহরে রয়েছে পুরাতন দুর্গ, যা এখন ভ্যাল ডি’আরাঁ জাদুঘর হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
স্বাদ ও ঐতিহ্যের মিশেল:
ভ্যাল ডি’আরাঁ-এর রন্ধনশৈলীও বেশ জনপ্রিয়। এখানকার স্থানীয় উপকরণ দিয়ে তৈরি খাবারগুলি খাদ্যরসিকদের মন জয় করে। ২০২৩ সালে ক্যাটালোনিয়া ইউরোপের গ্যাস্ট্রোনমির প্রথম বিশ্ব অঞ্চলের স্বীকৃতি লাভ করেছে। এখানে সিজনের বিভিন্ন সবজি, বুনো শুয়োরের মাংসের পেস্ট, নদীর মাছ এবং “ওলা আরানেসা”-র মতো বিশেষ পদ পরিবেশন করা হয়। এছাড়াও এখানকার ক্রিস্পি সাইডার ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ক্যাভিয়ারও খুব সুস্বাদু।
হালকা খাবারের জন্য এখানে পিনটোস-এর (ছোট আকারের স্প্যানিশ খাবার) চল রয়েছে। ভিয়েলহাতে মঙ্গলবার দিনটি পিনটো-পোটে নাইট হিসাবে পরিচিত, যেখানে অনেক বারে কম দামে পিনটো ও পানীয় পাওয়া যায়। ভিয়েলহার বিয়ারের দোকান “রেফু বিরেরিয়া”-তে বিভিন্ন ধরনের বিয়ার উপভোগ করা যেতে পারে। তাউয়েরনা দেথ গাসকন-এ ঐতিহ্যবাহী পেঁয়াজের স্যুপ ও রুস্টিক ডাইনিংয়ের ব্যবস্থা আছে। আর্টিয়েস-এর তাউয়েরনা উরতাউ-তে ভেনিসন কার্পাসিও এবং বোসোস-এর এল পোর্টালেট-এ গ্রিল করা বেগুন রাভিয়োলি ও ছাগলের মাংসের পদ পরিবেশন করা হয়।
ভ্যাল ডি’আরাঁ-এর প্রতিটি দিক, প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর দৃশ্য থেকে শুরু করে সংস্কৃতি আর খাবারের স্বাদ, এই স্থানটিকে ভ্রমণকারীদের জন্য এক আকর্ষণীয় গন্তব্য করে তুলেছে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক