ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে রাশিয়ার পক্ষ থেকে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবিত ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি নিয়ে বিস্তারিত তথ্য চেয়ে পাঠিয়েছে ক্রেমলিন। সৌদি আরবে মার্কিন ও ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনার পর রাশিয়া এই পদক্ষেপ নিল।
রাশিয়ার মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানিয়েছেন, মস্কো ওয়াশিংটনের কাছ থেকে ‘বিস্তারিত তথ্যের’ অপেক্ষা করছে। তিনি আরও জানান, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারকো রুবিও এবং উপদেষ্টা মাইকেল ওয়াল্টজ বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে আলোচনার বিষয়গুলো তাদের জানাবেন। প্রয়োজনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে দ্রুত ফোনালাপের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারকো রুবিও নিশ্চিত করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে বুধবার রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। তিনি আয়ারল্যান্ডে এক বক্তব্যে বলেন, “আমরা সবাই রাশিয়ার প্রতিক্রিয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি এবং তাদের প্রতি যুদ্ধ বন্ধের কথা জোরালোভাবে বিবেচনা করার আহ্বান জানাচ্ছি। তারা যদি ‘না’ বলে, তাহলে আমাদের সবকিছু পরীক্ষা করতে হবে এবং বিশ্বের পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাদের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে হবে।”
হোয়াইট হাউজের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূত এবং ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মিত্র স্টিভ উইটকফকে চলতি সপ্তাহে মস্কো যাওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে তিনি রুশ নেতার সঙ্গে বৈঠকে বসতে পারেন। যদিও ক্রেমলিন এখনো এই বৈঠকের বিষয়ে নিশ্চিত করেনি।
অন্যদিকে, ইউক্রেন জানিয়েছে, তারা আগামী সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৩০ দিনের একটি সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির চিফ অব স্টাফ আন্দ্রেই ইয়ারমাক জানান, “আমরা ইতিমধ্যে একমত হয়েছি যে আগামী সপ্তাহে কারিগরি বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে দলগুলো বিস্তারিত আলোচনা শুরু করবে।” তিনি আরও বলেন, “এই বৈঠকের পর চাবি এখন রাশিয়ার হাতে। শান্তি চায় কে, তা বিশ্ব দেখবে।”
তবে পুতিন যুদ্ধবিরতি মানতে রাজি কিনা, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
কিছু রুশ কর্মকর্তা যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, রাশিয়া এখনই যুদ্ধ বন্ধ করতে রাজি নয়। কারণ, তাদের বাহিনী সম্প্রতি রাশিয়ার কুর্স্ক অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করেছে। গত বছর ইউক্রেন এখানে আকস্মিক হামলা চালিয়েছিল।
রাশিয়ার প্রভাবশালী সিনেটর কনস্তান্তিন কোসাচেভ টেলিগ্রামে লিখেছেন, “রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে… যেকোনো চুক্তি আমাদের শর্তে হতে হবে, আমেরিকার শর্তে নয়… ওয়াশিংটনেরও এটা বোঝা উচিত।” তিনি আরও যোগ করেন, “জয় আমাদের হবে।”
অন্যদিকে, রুশ মিডিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পার্লামেন্ট সদস্য মিখাইল শেরেমেত বলেছেন, রাশিয়া যুদ্ধ চালিয়ে যেতে আগ্রহী নয়, তবে একইসঙ্গে “তাদের সঙ্গে প্রতারণা” সহ্য করবে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার আগে রাশিয়া কিছু নিশ্চয়তা চাইবে। বিশেষ করে কুর্স্ক অঞ্চলের তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূখণ্ড নিয়ে তারা ছাড় দিতে নারাজ।
ক্রেমলিনের উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান, বিশিষ্ট রুশ পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক ফিওদর লুকিয়ানোভ বুধবার লিখেছেন, যুদ্ধবিরতি চুক্তি মস্কোর দীর্ঘদিনের অবস্থানের পরিপন্থী। তিনি বলেন, “অন্য কথায়, আমরা একটি ব্যাপক মীমাংসা কাঠামো তৈরি না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাব।”
পুতিন একাধিকবার স্বল্পকালীন যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, সংঘাতের ‘মূল কারণগুলো’ মোকাবিলা করাই তার লক্ষ্য।
এ বছর শুরুতে রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদে তিনি বলেছিলেন, “সংক্ষিপ্ত যুদ্ধবিরতি নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী শান্তির প্রয়োজন।”
যুদ্ধ বন্ধের জন্য পুতিন ইউক্রেনের প্রতি বেশ কিছু কঠিন শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে, ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা ত্যাগ করতে হবে, আংশিকভাবে সামরিক শক্তি কমাতে হবে এবং ২০১৪ সালে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা চারটি অঞ্চলের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে হবে।
যুদ্ধবিরতির বিষয়ে রাশিয়ার এই দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাবের কারণ হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক। ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের ভালো সম্পর্ক রয়েছে এবং এর কারণে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার প্রতি ইউরোপের চেয়ে ভিন্ন নীতি গ্রহণ করেছে।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, রাশিয়া হয়তো কুর্স্ক অঞ্চলের সব ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করবে অথবা যুদ্ধবিরতির আলোচনার আগে ইউক্রেনকে ওই এলাকা থেকে সরে যেতে বলতে পারে।
বুধবার রুশ বাহিনী কুর্স্কের বৃহত্তম শহর সুজা-র কেন্দ্রে প্রবেশ করেছে। গত বছর ইউক্রেন শহরটি দখল করে নিয়েছিল। কিয়েভের আকস্মিক অভিযানের পর অঞ্চলটিতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার এটি রাশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
কনফ্লিক্ট ইন্টেলিজেন্স টিমের প্রতিষ্ঠাতা রুসলান লেভিয়েভ বলেছেন, কুর্স্ক অঞ্চলে ইউক্রেনীয় বাহিনী সম্ভবত নিয়ন্ত্রিতভাবে পশ্চাদপসরণ করছে এবং কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই তাদের অবস্থান ছেড়ে দিচ্ছে।
লেভিয়েভ বলেন, “সমস্ত এলাকা ধীরে ধীরে রুশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আসছে এবং সামান্যতম প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে। এটা বলা যেতে পারে যে সুজা শহর এখন সম্পূর্ণরূপে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে।”
কুর্স্ক অঞ্চলে ইউক্রেনের অবস্থা খারাপ হলেও, তারা পূর্ব ইউক্রেনে ফ্রন্ট লাইন স্থিতিশীল রাখতে সক্ষম হয়েছে, যেখানে রাশিয়ার আক্রমণ মূলত থমকে গেছে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান