শিল্পকলার এক নতুন সৃষ্টি, যা ম্যানচেস্টারের দাসত্বের ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি
ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হিসেবে পরিচিত নীল রঙের একটি পোশাক, যা তৈরি করেছেন শিল্পী হলি গ্রাহাম। ম্যানচেস্টার আর্ট গ্যালারিতে সম্প্রতি উন্মোচন করা হয়েছে এই শিল্পকর্মটি। এটি তৈরি করা হয়েছে মূলত ১৮৫৯ সালে এখানে আসা আফ্রিকান-আমেরিকান দাসপ্রথা বিরোধী নারী সারা পার্কার রেমন্ডের একটি ভাষণের স্মৃতিস্বরূপ।
পোশাকটির নকশা তৈরি করতে গিয়ে হলি গ্রাহাম রেমন্ডের পোশাকের আদল অনুসরণ করেছেন। পোশাকের সূক্ষ্ম কারুকার্যে আফ্রিকা, আমেরিকা ও ইউরোপ—এই তিনটি মহাদেশের যোগসূত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এর মাধ্যমে ম্যানচেস্টারের সঙ্গে দাসত্বের সম্পর্ককে দৃশ্যমানভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে, ভিক্টোরিয়ান যুগে ম্যানচেস্টারের শিল্প বিপ্লবে তুলার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এই তুলাই ছিল মানুষ কেনাবেচার সঙ্গে ম্যানচেস্টারের সংযোগের প্রধান মাধ্যম।
ঐতিহাসিক এই ঘটনার স্মরণে তৈরি করা পোশাকটিতে ভিক্টোরিয়ান যুগের পোশাকের বৈশিষ্ট্যগুলো আনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পেটিকোট, কোমরবন্ধ, প্যান্টালুন, কেমিজ এবং ক্রিনোলাইন। শিল্পী হলি গ্রাহাম জানিয়েছেন, তিনি এই পোশাকের মাধ্যমে সারা পার্কার রেমন্ডের কণ্ঠস্বরকে আবারও মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। তাঁর মা, মঞ্চ ও চলচ্চিত্রের পোশাক শিল্পী জেনিফার গ্রাহাম এবং গবেষকদের সহায়তায় তৈরি হয়েছে এই পোশাক।
পোশাকটির নকশার অনুপ্রেরণা এসেছে রয়্যাল ম্যানচেস্টার ইনস্টিটিউশনের (আরএমআই) সদস্যপদ গ্রহণকারীদের নিবন্ধন বইয়ের মার্বেল করা কাগজ থেকে। ১৮২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ম্যানচেস্টার আর্ট গ্যালারির যোগসূত্র রয়েছে। একসময় এই প্রতিষ্ঠানের অর্থদাতাদের মধ্যে চেশায়ারের কোয়ারি ব্যাংক মিলের গ্রেগ পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন, যারা ডোমিনিকায় দাসত্বের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
ব্রিটিশ সংস্কৃতির ইতিহাসে কীভাবে দাসপ্রথা বিরোধী আন্দোলনকে তুলে ধরা হয়েছে, সেই বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তোলে। তবে কেন এই নীতির প্রয়োজনীয়তা ছিল, তা সবসময় সামনে আনা হয় না।
পোশাকের নকশায় “গিনি ক্লথ” (Guinea cloth) নামক একটি কাপড়ের নমুনা ব্যবহার করা হয়েছে। এই কাপড়টি “ম্যানচেস্টার চেক” নামেও পরিচিত, যা একসময় মানুষ ও পণ্যের “ত্রিভুজ বাণিজ্য”-এর অংশ হিসেবে পশ্চিম আফ্রিকার বাজারে সরবরাহ করা হতো। গ্রাহাম আরও বলেন, “আরএমআইয়ের খাতায় যেসব ব্যক্তির নাম ছিল, তাঁদের মধ্যে কার অর্থ দিয়ে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল, আবার কাদের শ্রমের বিনিময়ে এই অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছিল—সে বিষয়টি তুলে ধরতেই আমার এই প্রচেষ্টা।”
সারা পার্কার রেমন্ড ১৮৫০-এর দশকে ইংল্যান্ডে এসেছিলেন। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল মিল মালিক ও শ্রমিকদের আমেরিকার দাসপ্রথা বিলোপের আন্দোলনে সমর্থন জানানো এবং দক্ষিণের plantation মালিকদের বিরুদ্ধে অবরোধের পক্ষে জনমত তৈরি করা।
সারা পার্কার রেমন্ড ছিলেন একজন চিকিৎসক এবং একই সঙ্গে নারী অধিকার আন্দোলনের কর্মী। তিনি এক বন্ধুকে লিখেছিলেন, “শ্বেতাঙ্গ নারীরা আমাকে প্রথমবারের মতো তাদের বোন হিসেবে গ্রহণ করেছে। আমি এমন সহানুভূতি পেয়েছি যা আগে কখনো পাইনি।”
ম্যানচেস্টারে আসার পর রেমন্ড সেখানকার মানুষের কাছে আমেরিকার দাসত্বের সঙ্গে ম্যানচেস্টারের যোগসূত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেছিলেন, “আপনাদের [থমাস] ক্লার্কসন ও [উইলিয়াম] উইলবারফোর্স [দাসপ্রথা বিলোপকারী] আমাদের কাছে শক্তির প্রতীক। আমি আপনাদের কাছে আবেদন জানাচ্ছি, আপনারা জনমত তৈরি করুন, যাতে এর আওয়াজ আমেরিকার তীরে পৌঁছায়… যতক্ষণ না আমেরিকার ক্রীতদাসদের শৃঙ্খল সকালের শিশিরের মতো গলে যায়। আমি বিশেষভাবে ইংল্যান্ডের নারীদের সাহায্য চাই। নারীরাই তো দাসত্বের সবচেয়ে বড় শিকার।”
ম্যানচেস্টারের অর্থনীতি যখন তুলা ব্যবসার মাধ্যমে ফুলেফেঁপে উঠছিল, রেমন্ড তাঁর শ্রোতাদের মনে করিয়ে দেন, “এই ব্যবসার একটি পয়সাও ক্রীতদাসদের কাছে পৌঁছায়নি।” একই সময়ে এই শহরটি দাসপ্রথা বিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। অ্যান্টি-স্ল্যাভারি ক্যাম্পেইনার রিচার্ড কোবডেন ছিলেন ম্যানচেস্টার আথেনিয়ামের প্রতিষ্ঠাতা। এখানে আফ্রিকান-আমেরিকান রাষ্ট্রনায়ক ও লেখক ফ্রেডারিক ডগলাসও বক্তৃতা করেছিলেন।
ম্যানচেস্টার সিটি গ্যালারির সিনিয়র ক্রিয়েটিভ লিড ইনবাল লিভনে বলেছেন, “ম্যানচেস্টার আর্ট গ্যালারি শহরের জটিল ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হলি গ্রাহামের কাজ সাম্রাজ্য, উপনিবেশবাদ এবং অতীতের শোষণকে বর্তমানের প্রতিনিধিত্ব, বর্ণবাদ এবং ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত করার এক দারুণ সুযোগ তৈরি করেছে।”
সারা পার্কার রেমন্ড এবং ফ্রেডারিক ডগলাস—উভয়ের কথা গার্ডিয়ান পত্রিকার “কটন ক্যাপিটাল” সিরিজে প্রকাশিত হয়েছিল। এই সিরিজটি গার্ডিয়ান ফাউন্ডারদের ট্রান্সআটলান্টিক দাসত্বের সঙ্গে সংযোগের ফলস্বরূপ তৈরি হওয়া একটি ১০ বছর মেয়াদী “ক্ষতিপূরণমূলক বিচার” প্রকল্পের অংশ।
হলি গ্রাহামের এই শিল্পকর্মটি “দ্য ওয়ার্প/দ্য ওয়েফট/দ্য ওয়েক” (The Warp/ The Weft/ The Wake) শিরোনামে প্রদর্শিত হচ্ছে এবং এটি ১৫ই মার্চ, ২০২৬ পর্যন্ত ম্যানচেস্টার আর্ট গ্যালারিতে সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান