গাজায় ইসরায়েলি হেফাজতে থাকা ফিলিস্তিনিদের স্বজন হারানোর খবর গোপন রাখার অভিযোগ।
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা ফিলিস্তিনি বন্দিদের পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর খবর জানানো হয়নি। মুক্তি পাওয়ার পরেই তাঁরা জানতে পারেন তাঁদের প্রিয়জনদের হারানোর খবর।
সম্প্রতি এমনটাই জানা গেছে। খবর অনুযায়ী, দীর্ঘদিন ধরে আটক থাকা এই ফিলিস্তিনিদের বাইরের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল, যার ফলে তাঁদের পরিবারের কোনো সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ ছিল না।
আহমেদ ওয়াইল দাবাবিশ নামের এক ফিলিস্তিনি জানান, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ইসরায়েলি সেনা সদস্যরা একটি স্কুলে আশ্রয় নেওয়া তাঁর স্ত্রী আসমা, দুই মেয়ে এবং ছেলেকে আলাদা করে ফেলে।
সেনাদের নির্দেশে পুরুষদের উঠানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাঁদের মধ্যে দাবাবিশকেও আটক করা হয়। ১৩ মাস ধরে কোনো অভিযোগ ছাড়াই তাঁকে আটকে রাখা হয়।
এই সময়কালে তিনি পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারেননি। এমনকি আইনজীবীর সঙ্গেও দেখা করার সুযোগ পাননি।
দাবাবিশ যখন কারাগারে ছিলেন, তখন ইসরায়েলি গোলার আঘাতে তাঁর স্ত্রী ২৯ বছর বয়সী আসমা এবং তিন বছর বয়সী ছোট মেয়ে ঘিনা নিহত হন। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি যখন তাঁর বাবাকে দেখেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই খুব খুশি হয়েছিলেন।
কিন্তু পরিবারের সদস্যদের বিষয়ে জানতে চাওয়ার পরেই তাঁর জীবনে নেমে আসে চরম দুঃখের ছায়া। তাঁর বাবা মোবাইলে ঘিনার একটি ছবি দেখান, যেখানে ছোট্ট ঘিনার মরদেহ তার এক ফুফুর মেয়ের পাশে রাখা ছিল।
দাবাবিশ বলেন, “আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারি না যে তারা মারা গেছে।”
এই ঘটনার পরে, দাবাবিশের ছয় বছর বয়সী ছেলে মুয়াধ এবং আট বছর বয়সী মেয়ে আয়েশা বাবাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে। দাবাবিশের মতো এমন ঘটনা আরও অনেকের সঙ্গেই ঘটেছে।
‘দি অবজার্ভার’-এর সঙ্গে কথা হয় গাজার আরও তিনজন ফিলিস্তিনির, যাঁদের পরিবারের সদস্যরা ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী অথবা ইসরায়েলি বেসামরিক কারাগারে আটক থাকার সময় নিহত হয়েছেন। মুক্তির পরেই তাঁরা তাঁদের স্বজন হারানোর খবর জানতে পারেন।
এই তিনজন হলেন বেসামরিক নাগরিক। তাঁদের মধ্যে একজন নার্স, একজন সরকারি কর্মচারী এবং একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
তাঁরা জানিয়েছেন, কখনো কোনো অস্ত্র ধরেননি তাঁরা। কারাগারে তাঁদের কোনো আইনজীবী পাওয়ার সুযোগ হয়নি এবং পরিবারের সঙ্গেও কথা বলতে পারেননি।
আইন ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, গাজা থেকে আটক হওয়া আরও অনেক বন্দি রয়েছেন, যাঁরা ইসরায়েলি হামলায় তাঁদের পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন, কিন্তু তাঁদের মৃত্যুর খবর জানানো হয়নি।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলা চালানোর পর থেকে ইসরায়েলে আটক ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব বা স্বজনদের দেখা করা, চিঠি লেখা অথবা ফোনে কথা বলার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এমনকি তাঁদের সেল থেকে টেলিভিশন এবং রেডিও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ফিলিস্তিনি বন্দিদের অধিকার বিষয়ক সংগঠন ‘আদ্দামির’-এর তালা নাসির বলেন, “বন্দিদের ওপর এই বিচ্ছিন্নতা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারা চায় না বন্দিরা তাদের পরিবার এবং প্রিয়জনদের সম্পর্কে কোনো খবর জানুক।”
যাঁদের আইনজীবী পাওয়ার সুযোগ হয়েছে, তাঁরা হয়তো আইনজীবীর মাধ্যমে কিছু খবর জানতে পেরেছেন। কিন্তু গাজার এমন বহু বন্দি আছেন, সম্ভবত হাজার হাজার, যাঁদের কোনো আইনজীবী নেই।
ইসরায়েলের ‘বেআইনি যোদ্ধা আইন’-এর অধীনে তাঁদের বেশিরভাগকে আটক রাখা হয়েছে। এই আইনে কোনো প্রমাণ ছাড়াই অনির্দিষ্টকালের জন্য কাউকে আটকে রাখার সুযোগ রয়েছে।
কোনো ব্যক্তিকে আইনজীবী পাওয়ার সুযোগ দেওয়ার আগে বা বিচারকের সামনে হাজির করার আগে রাষ্ট্র তাকে ৪৫ দিন পর্যন্ত আটকে রাখতে পারে। যুদ্ধের শুরুতে এই সময়সীমা ১৮০ ও ৭৫ দিন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই ব্যবস্থাটিকে ‘যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে আটক রাখা, গুম করাকে বৈধতা দেয় এবং এটি বাতিল করা উচিত’ বলে মন্তব্য করেছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে গাজায় আটক হওয়া কারও বিচার হয়নি।
ইসরায়েলে ফিলিস্তিনি বন্দিদের জন্য সরকার কোনো আইনজীবী নিয়োগ করে না। এমনকি সেখানকার আইন সহায়তা প্রদানকারী সংগঠনগুলোর পক্ষেও এখনকার পরিস্থিতিতে বন্দিদের সহায়তা করা কঠিন।
দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের জন্য কাজ করা একটি ইসরায়েলি সংগঠন ‘হামোকেদ’-এর নির্বাহী পরিচালক জেসিকা মন্টেল বলেন, “আমি নিশ্চিত যে, গাজায় আটক হওয়া অধিকাংশ বন্দিই কোনো আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। হামোকেদের কর্মীরা ইসরায়েলের ভেতরে আটক হওয়া হাজার হাজার বন্দির মধ্যে মাত্র কয়েক ডজনের সঙ্গে দেখা করতে পেরেছেন।”
নানা ধরনের প্রশাসনিক জটিলতা এবং কারাগারগুলোর দূরত্বের কারণেও বন্দিদের সঙ্গে দেখা করা কঠিন হয়ে পড়ে। তালা নাসিরের মতে, আইনজীবীরা যখন গাজার বন্দিদের সঙ্গে দেখা করেন, তখন তাঁদের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ হয় তাঁদের স্বজন হারানোর খবর জানানো।
ডিসেম্বরে, ইসরায়েল জানায় যে তারা ‘বেআইনি যোদ্ধা আইন’-এর অধীনে গাজা থেকে আসা ৩,৪০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনিকে আটক করেছে। এর আগে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এনে একটি প্রচারণা চালায় ‘পাবলিক কমিটি এগেইনস্ট টর্চার ইন ইসরায়েল’ (পিসিএটিআই)।
যুদ্ধবিরতির সময় অন্তত ১,০০০ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো হাজার হাজার মানুষ কারাগারে বন্দী রয়েছেন। পিসিএটিআই-এর পরিচালক তাল স্টেইনার জানান, ইসরায়েলের কারাগারে গাজা থেকে আসা প্রায় ১,৫০০ বন্দী রয়েছে।
তাঁর মতে, “এটা অনুমান করা যেতে পারে যে, কয়েকশ ফিলিস্তিনি বন্দী এখনো সামরিক ক্যাম্পে আটক রয়েছে।”
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানায়নি যে, তারা কতজন ফিলিস্তিনিকে আটক করে রেখেছে বা কতজনের সঙ্গে আইনজীবীর দেখা হয়েছে। তবে তারা বলেছে, বন্দীদের সঙ্গে আইনজীবীদের আলোচনার বিষয়বস্তু বা আইনজীবীরা কী ধরনের কাগজপত্র নিয়ে যেতে পারবেন, সে বিষয়ে কোনো বিধিনিষেধ নেই।
ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “অনেক বন্দী এরই মধ্যে আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করার অধিকার প্রয়োগ করেছেন। ইসরায়েল ফিলিস্তিনি বন্দিদের বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করছে।”
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বন্দীদের সঙ্গে আচরণে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলে এবং পদ্ধতিগত নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করে।
ইব্রাহিম দাউদ নামের এক সরকারি কর্মচারী যুদ্ধবিরতির সময় মুক্তি পান। তিনি জানান, তাঁর কোনো আইনজীবী পাওয়ার সুযোগ হয়নি। এমনকি নিজের নির্দোষ প্রমাণ করার সুযোগ চাওয়ায় তাঁকে মারধর করা হয়েছে।
তিনি বলেন, “আমার বন্ধুরা আমাকে হিব্রু ভাষায় কিছু কথা শিখিয়েছিল, যাতে আমি সৈন্যদের কাছে বিচার চেয়ে অফিসারদের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চাইতে পারি। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পথে এবং ফেরার পথে তারা আমাকে মারধর করত। আমি তাদের বারবার বলতাম, তারা যেন আমার কথা শোনে এবং আমি যা করিনি, সে জন্য যেন আমাকে অভিযুক্ত না করে।”
নেগেভ মরুভূমিতে ১৩ মাস কারাগারে কাটানোর পর তিনি মুক্তি পান। ইসরায়েলি হামলায় আহত হয়ে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন।
অসুস্থতা, ক্ষুধা এবং মারধরের পাশাপাশি পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার মানসিক কষ্ট তাঁকে আরও বেশি যন্ত্রণা দিয়েছে।
মুক্তি পাওয়ার পরে তিনি জানতে পারেন, তাঁর পরিবারের বাড়িটি ইসরায়েলি বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে, যেখানে তাঁর বাবা, বোন, ভাবি এবং তাঁর তিন সন্তান নিহত হয়।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান