চীনের বাণিজ্য যুদ্ধ: ট্রাম্পের শুল্কের মোকাবিলায় বন্ধু খুঁজছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের চলমান বাণিজ্য যুদ্ধ ক্রমেই তীব্র হচ্ছে।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন শুল্কের বোঝা আরও বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়ায়, চীন এখন নতুন বাণিজ্য মিত্র খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। এমনটাই জানা যাচ্ছে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম থেকে।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, এমনকি তিনি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে চিঠিও লিখেছেন। বাণিজ্য সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে তিনি ‘ড্রাগন-এলিফ্যান্ট ট্যাঙ্গো’র ধারণা দিয়েছেন, যা উভয় দেশের জন্য লাভজনক হবে বলে তিনি মনে করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বাধাগুলো এড়িয়ে চলতে চীন এখন অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়াতে চাইছে। গত বছর ট্রাম্প প্রশাসন চীনের ওপর প্রায় ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, যা পরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪ শতাংশে, এবং বর্তমানে গড় হারে তা ৬৫ শতাংশে পৌঁছেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই শুল্কের কারণে চীনা পণ্যের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় তা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। এর প্রতিক্রিয়ায় চীনও পাল্টা ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে।
চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়াবে। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
তারা আশঙ্কা করছেন, বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে মন্দা দেখা দিতে পারে, যার ফলশ্রুতিতে অনেক কোম্পানি বিনিয়োগ ও কর্মী ছাঁটাই করতে বাধ্য হবে।
চীনের পক্ষ থেকে ভর্তুকি বাড়িয়ে বা ডাম্পিংয়ের মাধ্যমে বিদেশি বাজার দখলেরও একটা সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এছাড়া, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি দুর্বল হওয়ার কারণে, বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসারও আশঙ্কা রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার চেষ্টা করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। যুক্তরাজ্যের প্রাক্তন ট্রেজারি মন্ত্রী জিম ও’নিল মনে করেন, ট্রাম্পের এই শুল্ক নীতির কারণে চীন ও অন্যান্য দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক আরও জোরদার হবে।
তিনি উল্লেখ করেন, জি-৭ ভুক্ত দেশগুলো এক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে পারে এবং ভারত ও চীনকেও এই জোটে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
চীন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ইইউ-তে বেশি পণ্য রপ্তানি করে। ট্রাম্পের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রপ্তানি কমেছে, যদিও কোভিড পরিস্থিতিতে চীনের রপ্তানি বেড়েছিল।
চীন যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৪৪০ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৪৮,৪০০ কোটি টাকা) মূল্যের পণ্য পাঠায়, সেখানে ইইউ-এর ২৭টি সদস্য রাষ্ট্রে প্রায় ৫৮০ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৬৩,৮০০ কোটি টাকা) মূল্যের পণ্য রপ্তানি করে।
অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষক ক্রিস্টোফার ডেন্ট মনে করেন, ট্রাম্পের আগ্রাসী বাণিজ্য নীতির কারণে অন্যান্য দেশগুলো নিজেদের মধ্যে শক্তিশালী বাণিজ্য জোট তৈরি করতে বাধ্য হবে।
ইইউ ও চীন তাদের মধ্যকার বাণিজ্য বিরোধগুলো মিটিয়ে বাণিজ্য উদারীকরণের পক্ষে কাজ করতে পারে। যুক্তরাজ্যও এই পরিস্থিতিতে বেশ চাপে রয়েছে।
তারা ট্রাম্পের আরোপিত সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ শুল্ক থেকে রক্ষা পেলেও, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে চাইছে। তবে, চীনের সস্তা পণ্যের কারণে যুক্তরাজ্যের বাজারেও প্রভাব পড়তে পারে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চেম্বারের প্রধান জন ডেন্টন এই শুল্ক যুদ্ধকে ১৯৭০-এর দশকের তেল সংকটের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি মনে করেন, এটি চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিশ্ব বাণিজ্যে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই।
এই পরিস্থিতিতে, অনেক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নেতা শুল্ক আরোপের প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে ধস নামতে পারে।
চীন এখন চেষ্টা করছে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানোর। একইসঙ্গে তারা বিদেশি কোম্পানিগুলোকে চীনে কারখানা স্থাপন করতে উৎসাহিত করছে।
তবে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা কম। ট্রাম্প প্রশাসন সম্ভবত চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক সীমিত করতে চায়, যাতে আমেরিকানরা চীনা পণ্য বেশি দামে কিনতে বাধ্য হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের রপ্তানি যদি কমেও যায়, তবে দেশটির অর্থনীতির ওপর এর প্রভাব খুব বেশি হবে না। কারণ, চীনের অর্থনীতিতে রপ্তানির অবদান মাত্র ২ শতাংশ।
তবে, বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে যদি বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়, তাহলে চীনের জন্য তা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই পরিস্থিতিতে, চীনের নীতিনির্ধারকরা সম্ভবত তাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য আরও পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
বাংলাদেশের জন্য এই বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাব বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই বাংলাদেশের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার।
তাই, বিশ্ব অর্থনীতির এই পরিবর্তনে বাংলাদেশের অর্থনীতিকেও প্রস্তুত থাকতে হবে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান