যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে শঙ্কা, ট্রাম্পের শুল্ক নীতির কারণে অনিশ্চয়তা বাড়ছে
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বর্তমানে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। একদিকে যেমন বাড়ছে ছাঁটাইয়ের সংখ্যা, তেমনই ভোক্তাদের ব্যয়ের পরিমাণও অপ্রত্যাশিতভাবে কমে গেছে। এমনকি কমেছে জনগণের আস্থা। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক জিডিপি’র পূর্বাভাসও হঠাৎ করে নেতিবাচক হয়ে পড়েছে। ওয়াল স্ট্রিটে দেখা যাচ্ছে চরম অস্থিরতা, গত মাসে শেয়ার বাজারে দরপতন হয়েছে।
এমন একটি টালমাটাল পরিস্থিতিতে দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি অর্থনীতিতে নতুন করে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। তিনি মেক্সিকো ও কানাডা থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ এবং চীন থেকে আসা পণ্যের ওপর বিদ্যমান শুল্ক দ্বিগুণ করে ২০ শতাংশ করার ঘোষণা দিয়েছেন। যদিও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এর পরিমাণে পরিবর্তন আসতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই শুল্ক বৃদ্ধি কার্যকর হলে, মূল্যস্ফীতি ফেডারেল রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রার উপরেই থাকবে। ফলে ঋণ নেওয়ার খরচ কমানো কঠিন হয়ে পড়বে, যা ভোক্তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়াবে। মেক্সিকো ও কানাডা এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে, যা বাণিজ্য যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করেছে। চীনও শুল্ক বাড়ালে এর জবাব দেওয়ার কথা জানিয়েছে।
শুল্কের এই অনিশ্চয়তা ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক ধরনের দ্বিধা তৈরি করেছে। বিনিয়োগকারী, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এবং ভোক্তারা তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে সমস্যা অনুভব করছেন। জানুয়ারিতে বাণিজ্য নীতি বিষয়ক অনিশ্চয়তা সূচক ১৯৬০ সালের পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
পরিবহন সরঞ্জাম সরবরাহকারী একটি মার্কিন কোম্পানি জানিয়েছে, শুল্ক নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে গ্রাহকরা নতুন অর্ডার দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। কিভাবে এই শুল্ক বাস্তবায়ন করা হবে সে বিষয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না, যার ফলে ব্যবসার ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
খেলনা প্রস্তুতকারক কোম্পানি ‘বেসিক ফান!’-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জে ফোরম্যান জানান, তাঁর কোম্পানি গত মাস থেকে চীনের তৈরি পণ্যের ওপর আরোপিত ১০ শতাংশ শুল্কের সঙ্গে লড়াই করা শুরু করেছে। এখন অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্কের হুমকি তাদের ব্যবসার জন্য প্রায় ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ৫৪ কোটি টাকা) ক্ষতির কারণ হতে পারে। কারণ, তাদের প্রায় ৯০ শতাংশ খেলনা চীন থেকে আসে।
ফোরম্যান জানান, গ্রাহকদের সঙ্গে তাদের চুক্তি অনুযায়ী, ২০২৬ সাল পর্যন্ত শুল্কের অতিরিক্ত খরচ তাদেরই বহন করতে হবে। ট্রাম্প যদি উৎপাদন যুক্তরাষ্ট্রেই সরিয়ে নিতে বলেন, তবে সেটি তাদের জন্য আর্থিকভাবে লাভজনক হবে না। কারণ খেলনা তৈরির মতো কিছু জিনিস এখানে তৈরি করা সম্ভব নয়। চীনের শ্রমবাজার, উৎপাদন খরচ এবং উৎপাদন ক্ষমতার কারণে খেলনা তৈরির ক্ষেত্রে চীন একটি অপরিহার্য স্থান।
তবে উৎপাদন যুক্তরাষ্ট্রে সরিয়ে নিলেও পণ্যের দাম বাড়াতে হবে, যা ভোক্তাদের জন্য আরও কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করবে। উদাহরণস্বরূপ, ১০ ডলারের একটি পুতুল হয়তো ৩০ ডলারে বিক্রি করতে হতে পারে।
অন্যদিকে, খাদ্য প্রস্তুতকারক সংস্থা ‘চিপটল’-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্কট বোটরাইট জানিয়েছেন, তারা শুল্কের কারণে হওয়া অতিরিক্ত খরচ এ বছর শুষে নিতে চান এবং পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে চান। তিনি বলেন, শুল্ক যদি দীর্ঘমেয়াদী হয়, তাহলে হয়তো পণ্যের দাম বাড়াতে হতে পারে।
শুধু চীন নির্ভর কোম্পানিগুলোই নয়, অ্যালুমিনিয়াম প্রস্তুতকারক বৃহত্তম মার্কিন কোম্পানি ‘আলকোয়া’-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সতর্ক করে বলেছেন, ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ২৫ শতাংশ শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ১ লক্ষ মানুষের চাকরি হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাসও এরই মধ্যে কমে এসেছে। আটলান্টা ফেডারেল রিজার্ভের জিডিপি নাও মডেলের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে জিডিপি ২.৮ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে। জানুয়ারিতে ভোক্তাদের ব্যয়ের নিম্নমুখী প্রবণতা এবং নির্মাণ ও উৎপাদন খাতে দুর্বলতার কারণে এই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শুল্কের এই অনিশ্চয়তা আমেরিকান ভোক্তাদের মনে প্রভাব ফেলছে, যা ভোক্তা আস্থা সূচকে ঐতিহাসিক পতন ঘটিয়েছে।
প্যানথিয়ন ম্যাক্রোইকোনমিকস জানিয়েছে, কনফারেন্স বোর্ডের ভোক্তা আস্থা সূচক ডিসেম্বরের তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে ১১ পয়েন্ট কমেছে, যা ২০০৯ সালের মন্দার পর থেকে বছরের শুরুতে সবচেয়ে বড় পতন। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভোক্তা sentimento সূচকও একই সময়ে ৯ পয়েন্ট কমেছে, যা ১৯৭৮ সাল থেকে রেকর্ডকৃত তথ্য অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি।
তবে, অর্থনীতির এই দুর্বল চিত্র সাময়িক, নাকি আরও খারাপ পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে, তা বলা কঠিন। অতীতে যুক্তরাষ্ট্র বেশ কয়েকবার মন্দার শঙ্কা কাটিয়ে উঠেছে। বিনিয়োগ বিষয়ক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইয়ার্ডেনি রিসার্চের প্রেসিডেন্ট এড ইয়ার্ডেনি মনে করেন, জানুয়ারির তীব্র শীত এবং ওয়াশিংটনের নীতিগত অনিশ্চয়তার কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি সাময়িক। তিনি মনে করেন, অর্থনীতির মূল ভিত্তি খুবই শক্তিশালী এবং ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিগত অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও এটি টিকে থাকতে সক্ষম।
ইয়ার্ডেনি ট্রাম্পকে পরামর্শ দিয়েছেন, কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো উচিত। তাঁর মতে, শুল্ক একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় এবং এতে বেশি দিন আটকে থাকা উচিত নয়।
তথ্য সূত্র: সিএনএন