ফিলিস্তিনপন্থী কর্মী মাহমুদ খলিলের বিরুদ্ধে ভিসা আবেদনে তথ্য গোপনের অভিযোগ, বিতর্কে ট্রাম্প প্রশাসন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ফিলিস্তিনপন্থী কর্মী মাহমুদ খলিলকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে ট্রাম্প প্রশাসন। প্রথমে হামাসের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ আনা হলেও, সেই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি তারা। এরপর গ্রিন কার্ড বা স্থায়ী বসবাসের অনুমতিপত্রের জন্য করা আবেদনে তথ্য গোপন করার অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। আইনজীবীরা বলছেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই এমনটা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, মাহমুদ খলিল তার গ্রিন কার্ড আবেদনে বৈরুতে অবস্থিত ব্রিটিশ দূতাবাসের সিরিয়া অফিসের সঙ্গে তার সম্পর্ক এবং জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্মসংস্থান সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ)-এর সদস্যপদ সম্পর্কে তথ্য দেননি। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার বলছে, এই কারণে তার বিতাড়ন হওয়া উচিত। উল্লেখ্য, ইউএনআরডব্লিউএ’কে দীর্ঘদিন ধরে ইহুদিবিদ্বেষের অভিযোগে অভিযুক্ত করে আসছেন মার্কিন ও ইসরায়েলি রাজনীতিবিদরা।
আদালতে দাখিল করা নথিতে মার্কিন সরকার জানিয়েছে, মাহমুদ খলিল ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করে প্রতারণার মাধ্যমে’ বসবাসের অনুমতি চেয়েছেন। এতে আরও বলা হয়, ‘রাজনৈতিক বক্তব্য যাই হোক না কেন, খলিল কিছু সংগঠনের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা জানাননি… এবং এমন তথ্য গোপন করাটা কোনোভাবেই বাক-স্বাধীনতার আওতায় পড়ে না।’
গত বসন্তে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের সময় কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে মধ্যস্থতাকারী ছিলেন মাহমুদ খলিল। গত ৮ মার্চ তাকে গ্রেপ্তার করে অভিবাসন ও কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই)। ওবামা-প্রশাসনে নিয়োগ পাওয়া বিচারক জেসি ফারমান খলিলকে এখনই দেশ থেকে বের করে দেওয়ার ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছেন এবং মামলাটি অন্য আদালতে স্থানান্তরিত করেছেন।
শুরুতে ট্রাম্প প্রশাসন খলিলকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি হিসেবে উল্লেখ করে। তাদের ভাষ্য ছিল, খলিলের উপস্থিতির কারণে ‘যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির গুরুতর ক্ষতি’ হতে পারে। তবে, কিভাবে তিনি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন, সে বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য জানায়নি তারা।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভের জেরে অভিবাসন বিষয়ক ধরপাকড় আরও জোরদার করেছে ট্রাম্প প্রশাসন।
মাহমুদ খলিলের আইনজীবীরা বলছেন, তাকে বিতাড়িত করার জন্য নতুন যে কারণ দেখানো হচ্ছে, তা খুবই দুর্বল। আইনজীবী বাহের আজমি সিএনএন-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমরা এতে মোটেও বিস্মিত নই, কারণ তারা বুঝতে পেরেছে আগের অভিযোগগুলো টেকে না। তাই তারা এখন এমন একটি তত্ত্বের আশ্রয় নিচ্ছে যা তাদের মতে, আইনের চোখে বেশি গ্রহণযোগ্য। তবে আমি মনে করি, এর মাধ্যমে প্রতিশোধের বিষয়টিই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।’
আদালতে শুনানির জন্য আগামীকালের মধ্যে খলিলের আইনজীবীরা নতুন অভিযোগের জবাব দেবেন বলে জানা গেছে।
আটকের পর আইনজীবীদের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে মাহমুদ খলিল নিজেকে ‘রাজনৈতিক বন্দী’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
ইউএনআরডব্লিউএ-কে ঘিরে বিতর্ক:
জাতিসংঘের এই সংস্থাটি (ইউএনআরডব্লিউএ) দীর্ঘদিন ধরেই মার্কিন ও ইসরায়েলি রাজনীতিবিদদের সমালোচনার শিকার। তাদের বিরুদ্ধে ইহুদিবিদ্বেষের অভিযোগ রয়েছে। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউএনআরডব্লিউএ গাজাসহ বিভিন্ন স্থানে বসবাস করা ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের আশ্রয়, স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য ও শিক্ষার মতো বিষয়গুলোতে সহায়তা করে থাকে। তবে ইসরায়েলে ইউএনআরডব্লিউএ-এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং গাজায় ফিলিস্তিনিদের সহায়তার ক্ষেত্রেও তারা নানা ধরনের বিধিনিষেধের সম্মুখীন।
গত বছর ইসরায়েল ইউএনআরডব্লিউএকে তাদের দেশে কাজ করতে নিষিদ্ধ করে। তাদের অভিযোগ, এই সংস্থা ‘ইহুদিবিদ্বেষ ছড়াচ্ছে’ এবং এর কিছু কর্মী গত ৭ অক্টোবরের হামাস হামলায় জড়িত ছিল। ওই হামলায় ১,২০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়।
ইউএনআরডব্লিউএ কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর বাইডেন প্রশাসনও তাদের তহবিল বন্ধ করে দেয়। এরপর আরও বেশ কয়েকটি দেশ একই পথে হাঁটে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও এক নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সংস্থাটিকে দেওয়া মার্কিন সহায়তা বন্ধ করে দেন। তার অভিযোগ ছিল, ইউএনআরডব্লিউএ-তে ‘দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্যরা অনুপ্রবেশ করেছে’।
তবে, ইউএনআরডব্লিউএ কর্তৃপক্ষ বরাবরই সন্ত্রাসীদের সাহায্য করার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তারা বলছে, তাদের বিভিন্ন স্থাপনা সন্ত্রাসবাদের কাজে ব্যবহারের যে অভিযোগ উঠেছে, তার নিরপেক্ষ তদন্ত করা উচিত।
ইউএনআরডব্লিউএ-এর প্রধান ফিলিপ্পে লাজ্জারিনি গত মাসে বলেছিলেন, ‘ইউএনআরডব্লিউএকে ভেঙে দিলে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের দুর্দশা আরও বাড়বে।’
আদালতের কাছে পরিবারের কাছাকাছি স্থানান্তরের আবেদন:
আটকের পর খলিলকে লুইজিয়ানার জেনা এলাকার একটি আইসিই ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানো হয়। তার আইনজীবীরা জানিয়েছেন, আদালত থেকে এর দূরত্ব এক হাজার মাইলেরও বেশি।
আদালতে জমা দেওয়া নথিতে সরকার জানিয়েছে, নিউ জার্সির একটি ডিটেনশন সেন্টার ‘বিছানার পোকার সমস্যা’ এবং স্থানের অভাবে তাদের জন্য উপযুক্ত ছিল না।
খলিলের আইনজীবীরা আদালতের কাছে আবেদন করেছেন, তাকে যেন তার পরিবারের কাছাকাছি, অর্থাৎ মামলার আদালতের কাছে কোনো ডিটেনশন সেন্টারে স্থানান্তর করা হয়। খলিলের স্ত্রী একজন মার্কিন নাগরিক এবং তিনি বর্তমানে সন্তানসম্ভবা। তবে, ট্রাম্প প্রশাসন বলছে, এ বিষয়ে আদালতের কোনো এখতিয়ার নেই।
খলিলের আইনজীবীর মতে, তার ভিসা আবেদন সঠিকভাবে পূরণ করা হয়েছিল কিনা, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আইসিই-এর নেই, বরং এই বিষয়টি বিচারকের বিবেচনা করা উচিত।
তথ্য সূত্র: সিএনএন