বরফের নিচে গোপন ঘাঁটি: ঠান্ডা যুদ্ধের এক অজানা অধ্যায়
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব নিয়ে যখন আলোচনা তুঙ্গে, তখন গ্রিনল্যান্ডের বরফের নিচে লুকিয়ে থাকা একটি গোপন সামরিক ঘাঁটির গল্প নতুন করে সামনে এসেছে। এক সময়ের পরাশক্তিধর দেশগুলোর মধ্যেকার স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনার সময়ে নির্মিত এই ঘাঁটির আসল উদ্দেশ্য ছিল ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি তৈরি করা। সম্প্রতি এর সাথে জড়িত একজন ডাক্তারের অভিজ্ঞতার কথা জানা গেছে, যা সেই সময়ের অনেক অজানা তথ্য উন্মোচন করে।
**গোপন অভিযানের শুরু**
সালটা ১৯৬২। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন—বিশ্বজুড়ে চলছে ঠান্ডা যুদ্ধের দামামা। এমনই এক পরিস্থিতিতে, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য হন ডা. রবার্ট ওয়াইজ। নিউইয়র্কের বেলভিউ হাসপাতালে চিকিৎসা প্রশিক্ষণ শেষ না করেই তাকে গ্রিনল্যান্ডের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠানো হয়। সেখানে তাকে ক্যাম্প সেঞ্চুরি নামক একটি মেরু গবেষণা কেন্দ্রে চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়।
ডা. ওয়াইজ জানান, “আমাকে উত্তর মেরু থেকে প্রায় ১৩০০ কিলোমিটার দূরে বরফের নিচে থাকতে পাঠানো হয়েছিল।” শুরুতে তিনি জানতেন না যে, এই ক্যাম্প আসলে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন প্রকল্প ‘আইসওয়ার্ম’-এর অংশ।
**প্রকল্প আইসওয়ার্ম ও ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি**
ক্যাম্প সেঞ্চুরির মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্ষেপণাস্ত্রের লঞ্চিং সাইট তৈরি করা। তৎকালীন সময়ে, যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছাকাছি ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি তৈরি করতে, যা তাদের জন্য কৌশলগত সুবিধা বয়ে আনবে। কিন্তু ডা. ওয়াইজ সহ সেখানে থাকা কর্মীদের অন্ধকারে রাখা হয়েছিল। ১৯৯০-এর দশকে গোপনীয়তা ভেঙে যাওয়ার পরেই তারা এই প্রকল্পের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে পারেন।
ক্যাম্প সেঞ্চুরি ছিল প্রকৌশলবিদ্যার এক অসাধারণ উদাহরণ। বরফের উপরে সাধারণত গবেষণা কেন্দ্র তৈরি করা হলেও, এখানে প্রায় ৮ মিটার গভীরতায় সুড়ঙ্গ খুঁড়ে সামরিক শহর তৈরি করা হয়েছিল। বরফের নিচে তৈরি করা হয়েছিল সুড়ঙ্গপথ, যেখানে সামরিক সরঞ্জাম ও জনবল পরিবহনের ব্যবস্থা ছিল। বিদ্যুতের জন্য ব্যবহার করা হতো একটি পারমাণবিক চুল্লি।
ডা. ওয়াইজের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, ক্যাম্পের জীবনযাত্রা খুব কঠিন ছিল না। প্রায় ২০০ জন সেনা সদস্যের জন্য এখানে ঘুমের জায়গা, শৌচাগার, গবেষণাগার, খাবার ঘর এবং শরীরচর্চার স্থান ছিল। সৈন্যদের জন্য সিনেমা প্রদর্শনেরও ব্যবস্থা ছিল। তবে, সৈন্যদের মধ্যে একাকীত্ব একটি বড় সমস্যা ছিল।
**গবেষণা ও পরিবেশগত ঝুঁকি**
ক্যাম্প সেঞ্চুরিতে একদিকে যেমন সামরিক কার্যক্রম চলত, তেমনই সেখানে ভূ-পদার্থবিদ্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণা করা হতো। বিজ্ঞানীরা এখানে বরফের গভীরতা পরিমাপের জন্য বিশেষ কোর ড্রিলিং করেন, যা সেই সময়ের আবহাওয়ার পরিবর্তনের একটি চিত্র তুলে ধরে। এই গবেষণার মাধ্যমে গত এক লক্ষ বছরের বেশি সময়ের জলবায়ু পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে।
কিন্তু ক্যাম্প সেঞ্চুরির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সেখানে ফেলে আসা বর্জ্য এখন পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বরফ গলে গেলে এই বর্জ্য বেরিয়ে আসতে পারে, যা পরিবেশের ক্ষতি করবে।
কানাডার একজন অধ্যাপক, যিনি ক্যাম্প সেঞ্চুরিতে যাওয়া প্রথম বিজ্ঞানীদের একজন, তিনি জানান, “ক্যাম্প সেঞ্চুরি ছিল প্যালিওক্লাইমাটোলজির (paleoclimatology) জন্মস্থান। এখান থেকে সংগৃহীত বরফের নমুনা থেকে পৃথিবীর অতীতের জলবায়ু সম্পর্কে জানতে পারা গেছে।”
ডা. ওয়াইজের মতে, ক্যাম্প সেঞ্চুরিতে কাটানো সময় তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তিনি বলেন, “যদিও আমি কখনো এই অভিযান চাইনি, তবে এটি আমার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা ছিল।”
তথ্য সূত্র: সিএনএন