তখন আমার বয়স সবে ১৪ বছর। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কৈশোরে পা দিয়েছি। বন্ধুদের সাথে মিশতে ভালো লাগলেও, নিজের ভেতরের দ্বিধা আর সংকোচ যেন কিছুতেই কাটাতে পারতাম না। সবার মাঝে নিজেকে কেমন যেন বেমানান লাগতো।
সমাজের চোখে একজন “আদর্শ” মেয়ে হওয়ার ধারণা আমাকে সারাক্ষণ কুড়ে কুড়ে খেত। সেই সময়ে, যখন পশ্চিমা সংস্কৃতি তরুণ-তরুণীদের মন জয় করতে শুরু করেছে, তখন টিভিতে ‘বেভারলি হিলস ৯০২১০’ (Beverly Hills 90210) এর মতো অনুষ্ঠানগুলো আর ম্যাগাজিনের ঝলমলে মডেলদের দেখে নিজেকে আরও অসহায় মনে হতো।
ঠিক তখনই, আমার জীবনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন হলো। একদিন পরিচিত এক বন্ধুর কাছ থেকে ধার করা ‘হোল’ (Hole) ব্যান্ডের প্রথম অ্যালবাম ‘প্রিটি অন দ্য ইনসাইড’ (Pretty on the Inside) শুনি। ব্যান্ডের প্রধান কণ্ঠশিল্পী ছিলেন কোর্টনি লাভ (Courtney Love)।
তাঁর কণ্ঠের চিৎকার যেন আমার ভেতরের সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভেঙে দিল। “যখন আমি ছিলাম এক কিশোরী পতিতা” – গানের এই কথাগুলো আমার কানে বাজতে শুরু করলো, যা আমাকে নতুন এক অনুভূতির সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিল।
কোর্টনি লাভের গানগুলো ছিল সমাজের প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মতো। তিনি যে শুধু গান লিখতেন তাই নয়, গিটারও বাজাতেন। তাঁর কণ্ঠের গভীরতা আর গানের কথার তীব্রতা আমাকে মুগ্ধ করলো।
তাঁর গানের মাধ্যমে আমি বুঝতে পারলাম, নারী মানেই শুধু “সুন্দর” আর “আদর্শ” হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। একজন নারী হিসেবে নিজের দুর্বলতাগুলোকেও উদযাপন করা যায়।
এরপর আমি পরিচিত হলাম আরও কিছু সাহসী নারী শিল্পীর সাথে – বেবস ইন টয়ল্যান্ড (Babes in Toyland), দ্য ব্রিডার্স (The Breeders), বিকিনি কিল (Bikini Kill)। তাঁরা তাঁদের শিল্পকর্মে নিজেদের ভেতরের সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, রাগ-অনুরাগ, সমাজের প্রতি বিদ্রোহ – সবকিছুই তুলে ধরতেন।
তাঁদের গানগুলো আমাকে এক নতুন পথের সন্ধান দিল।
কোর্টনি লাভ, বা অন্য শিল্পীরা, কেউই পারফেক্ট ছিলেন না। তাঁদের মধ্যেও ছিল অনেক ভুলত্রুটি, কিন্তু তাঁরা তাঁদের দুর্বলতাগুলো নিয়েই গর্বিত ছিলেন।
তাঁদের গান আমাকে শিখিয়েছিল, নিজেকে প্রকাশ করার জন্য সব কিছু “ঠিকঠাক” থাকতে হয় না। এই উপলব্ধি আমার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তোলে।
কাজের ক্ষেত্রেও আমি আমার মতামত প্রকাশ করতে শুরু করলাম। সমাজের প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে নিজের কথা বলায় একসময় অনেকে আমাকে “বদমেজাজি” বলতো। কিন্তু আমি আমার নীতি থেকে সরে আসিনি।
একটা সময় ভালো বেতনের চাকরি ছেড়ে দিয়ে আমি ফ্রিল্যান্সিং শুরু করি, কারণ আমি নিজের সঙ্গে আপস করতে রাজি ছিলাম না।
আজও, ত্রিশ বছর পরেও, কোর্টনি লাভ আমার কাছে অনুপ্রেরণার প্রতীক। তাঁর কণ্ঠস্বর, তাঁর গান, তাঁর বিদ্রোহ – কোনো কিছুই পুরনো হয় না।
আমি বিশ্বাস করি, সমাজের চোখে “আদর্শ” হওয়ার চাপ থেকে মুক্তি পেতে হলে, নারীদের নিজেদের কণ্ঠস্বর খুঁজে বের করতে হবে। তাঁদের “অপূর্ণতা” নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে, কারণ এই অপূর্ণতাই তাঁদের আসল শক্তি।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান